সারাক্ষণ রিপোর্ট
ভূমিকা
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তে বিস্তৃত গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা (জিবিএম) নদীবিধৌত বদ্বীপ ও সুন্দরবন মোহনা এলাকাটি এমন এক বিরল ইকোসিস্টেম, যেখানে মিঠা, খুনা ও লোনা জলের স্রোত মিলেমিশে গড়ে তুলেছে বিস্তৃত মাছের রাজ্য। এই পরিবেশে খ্যাতনামা ইলিশ থেকে শুরু করে চিংড়ি, বোম্বে ডাক বা গলদা—সব প্রজাতিই কোনও না কোনও মৌসুমে আবাস গড়ে তোলে। এ প্রতিবেদন সেই বৈচিত্র্য, প্রজনন-ভ্রমণচক্র এবং বর্তমান সংকট-সম্ভাবনার গল্প।
নদী ও উপকূলীয় পরিবেশের রূপ
সুন্দরবন ও ঘিরে থাকা মোহনার জলরাশি ৫৩টি পেলাজিক (উপরের স্তরের) ও ১২৪টি ডিমার্সাল (তলদেশঘেঁষা) মাছের আবাসস্থল, সঙ্গে ২৪টি চিংড়ি ও সাতটি কাঁকড়াসহ অসংখ্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী বাস করে । সমগ্র বঙ্গোপসাগরেই বর্ণিত হয়েছে অন্তত ৫১১টি মাছের প্রজাতি—যার বড় অংশই জিবিএম মোহনা ক্রমাগত খাবার, পলিমাটির আশ্রয় ও নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র জোগায় । লবণাক্ততার ঋতুভিত্তিক ওঠানামা, প্রচুর পুষ্টিসমৃদ্ধ পলি ও প্রবাহমান পানি এই মাছেদের চক্রবৃদ্ধি বাঁচিয়ে রাখে।
বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি
ইলিশ (Tenualosa ilisha)
বাংলাদেশের ‘স্বর্ণ মাছ’ বলে পরিচিত ইলিশ সমুদ্রেই বড় হয়; জুন–অক্টোবর বর্ষায় পূর্ণবয়স্ক ইলিশ দুর্দান্ত শক্তি নিয়ে মিঠাজলে ডিম ছাড়তে গঙ্গা, পদ্মা ও মেঘনায় উঠে আসে। দেশীয় মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই ইলিশ; এর পুষ্টিগুণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দুই-ই উল্লেখযোগ্য।
পাঙাশ (Pangasius pangasius)
মোহনা ও নদীতে বাসা বাঁধা এই বড়দেহী ক্যাটফিশ এখন দেশীয় জলাভূমিতে সংকটাপন্ন। অতিরিক্ত আহরণ ও আবাসহানি এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নদীর লবণাক্ততা সামলে খুনা–মিঠা দুই পানিতেই টিকে থাকার ক্ষমতা থাকলেও, বাধা-নির্মাণ ও দূষণ এদের চলাফেরা সীমিত করছে।
ভেটকি বা কোরাল (Lates calcarifer)
এশিয়ান সিব্যাস নামে পরিচিত এই শিকারি মাছ নদীর জোয়ারি অংশ থেকে সাগরের গভীর জল—দুই দিকেই স্বচ্ছন্দ। বাংলাদেশের উপকূলে চাষের পরীক্ষাও চলেছে, যা সাফল্য পেলে উপকূলীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে ।
বাগদা ও গলদা চিংড়ি (Penaeus monodon ও Macrobrachium rosenbergii)
বাগদা মূলত লবণাক্ত পানির, গলদা মিঠাজলের; কিন্তু দুই প্রজাতিই বাচ্চা অবস্থায় মোহনার পুষ্টিকর খুনা জলে বড় হয়। পুনরুত্পাদনচক্র সফল রাখতে নদীমাতৃক জলপ্রবাহ ও জোয়ারের ছন্দ অপরিহার্য।
বোম্বে ডাক (Harpadon nehereus)
মৃত্যুর পর তীব্র গন্ধের জন্য ‘বুম্বল মাছ’ নামে পরিচিত এ লিজার্ডফিশ সাধারণত সমুদ্রের কাদামাটির তলদেশে থাকে; বর্ষায় খাবার নিতে মোহনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে ।
ক্ষুদ্র দেশীয় প্রজাতির মুকুট
মলা (Amblypharyngodon mola), বাতাসি (Tachysurus bata) কিংবা পাইকারি বাজারে ওঠা গাঙ্গে লাটিয়া (Glossogobius giuris) প্রজাতিগুলিও খাদ্য-পুষ্টি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। ছোট এ মাছগুলো গ্রামীণ পুষ্টি নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখলেও, অতিরিক্ত জাল ফেলা ও পেস্টিসাইড প্রবাহে দ্রুত কমে যাচ্ছে।
প্রজনন ও অভিবাসনের চক্র
মৌসুমি বৃষ্টি ও নদীর প্রবাহ বাড়লে লবণাক্ততা কমে, তাতে ইলিশের মতো ডি-আড্রোমাস (সমুদ্র–নদী গমনকারী) মাছ ডিম ছাড়তে উঠে আসে। উল্টো শুকনা মরশুমে খরা ও মিষ্টি পানির স্বল্পতায় চিংড়ি ও ভেটকির মতো ইউরিহ্যালাইন মাছেরা বেশি সুবিধা পায়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমুদ্রস্তর ও বৃষ্টির অনিশ্চয়তা মাছের শতাব্দীপ্রাচীন অভিবাসন পথকে বিঘ্নিত করছে ।
হুমকি ও সংকট
• বেআইনি সূক্ষ্ম জাল ও অতিরিক্ত আহরণ
• নদীতে বাঁধ, ড্রেজিং ও শিল্পবর্জ্যে দূষণ
• জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তি লবণাক্ততা ও নদীপ্রবাহের পতন
• দ্রুত আর্থসামাজিক পরিবর্তনে মৎস্যজীবী যুথের বিকল্প পেশায় সরে যাওয়া
সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার
মৎস্য অধিদপ্তরের সমুদ্র-মোহনা অঞ্চলকে ‘ইলিশ অভয়াশ্রম’ ঘোষণাসহ কো-ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি, সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নিয়মিত টহল, জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমে জেলেদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা—সবগুলো উদ্যোগের সুফল মিলছে ধীরে ধীরে। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি ও আঞ্চলিক সমন্বয়হীনতা রয়ে গেছে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে।