০৩:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
ডেমোক্র্যাটদের নীতির ব্যর্থতা যেভাবে মামদানিকে জয়ী করল মার্কো রুবিওর উপস্থিতিতে ডিআরসি-রুয়ান্ডা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর কংগ্রেসের বহু নেতা ইন্দিরা জি ও জেপি-র সংলাপ চেয়েছিলেন, তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল তা হতে দেয়নি হিউএনচাঙ (পর্ব-১৩২) ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৭) সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা ব্যর্থ কলম্বো, গলের লড়াই -এ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঘরে জয় কেন ? ‘আকাশ হয়ে যাই’ মিউজিক ভিডিতে প্রশংসিত পূর্ণিমা বৃষ্টি সাউথ চায়নান মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ইরান আক্রমনে লাভ ক্ষতি

খাঁচা ভাঙব আমি: ২১ ফেব্রুয়ারির আলো ও ‘জীবন থেকে নেয়া’

  • Sarakhon Report
  • ০৫:০০:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
  • 47

সারাক্ষণ রিপোর্ট

১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঝরেছিল, সেটি ছিল বাঙালির মুক্তির ইতিহাসের প্রথম স্পষ্ট দাগ। ভাষার অধিকারের সেই দাবিই পরে রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে বিস্তৃত হয়। জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) এই ধারাবাহিকতাকে রূপক ও নাটকীয় ভাষায় তুলে ধরেছে—একদিকে ঘরের স্বৈরতন্ত্র, অন্যদিকে জনতার গণদাবি। এই ফিচারে ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বস্রোত, চলচ্চিত্র-বিশ্লেষণ এবং পরিচালক-লেখক জহির রায়হানের জীবন-কর্ম একসঙ্গে তুলে ধরা হলো।

ভাষা আন্দোলনের ভূমিকমঞ্চ

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পাঁচ বছরের মাথায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের আত্মাহুতিতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। সেই রক্তাক্ত সকালই ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট জয়, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে।

চলচ্চিত্রে প্রতিবাদের প্রতিফলন

  • গল্প আবর্তিত হয় এক দমন-পীড়িত পরিবারকে ঘিরে, যেখানে কর্ত্রীর হাতে তালার চাবি—সদস্যদের বাক্‌স্বাধীনতা ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের রূপক।
  • বাড়ির এই মাইক্রোকসম আসলে সামরিক-শাসিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিচ্ছবি।
  • বাড়ির ভেতরের গোপন গান-মিছিল ও বাইরে জনতার অপ্রতিরোধ্য স্লোগান—দুটি ধারাই দমন-পীড়নের দেয়াল ভেঙে গণজাগরণের পথ চিত্রায়িত করে।

সাউন্ডট্রাকে তিনটি মাইলফলক

  1. ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’—ভাষা-আন্দোলনের আবেগকে দগদগে রাখে।
  2. ‘আমার সোনার বাংলা…’—রবীন্দ্রনাথের গান (আজকের জাতীয় সংগীত) রিকশাযাত্রা ও মিছিলের দৃশ্যে শোনায়, মাটির টান ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উজ্জ্বল করে।
  3. ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি, কেমন করে বাঁচি’—আব্দুল লতিফের বিদ্রোহী সুর ছবির ব্রিজের দৃশ্যে প্রতীকি বন্ধন-ভাঙার আহ্বান হয়ে ওঠে, ভাষা-অধিকার থেকে জাতীয় মুক্তির আকুলতা একাকার করে।

রূপকের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস

চাবি-নির্ভর দমন ভেঙে তালা-চাবির ভাঙন জানিয়ে দেয়, স্বৈরশাসনের কৃত্রিম সীমানা আর টিকছে না। বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে গর্জে ওঠা জনতার মিছিল ও পতাকা ওড়ানো দৃশ্য ভাষা-আন্দোলনের বীজকে ১৯৭১-এর সবুজ-লাল মহীরুহে পরিণত হওয়ার বার্তাই বহন করে।

জহির রায়হান: জীবন ও কর্ম

  • জন্ম: ১৯ আগস্ট ১৯৩৫, ফেনী
  • শিক্ষা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য
  • সাহিত্য: ‘সোনার হরিণ’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’সহ গল্প-উপন্যাস
  • চলচ্চিত্র: ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১), ‘কাজল’ (১৯৬৫), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)
  • মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদান: তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এবারের সংগ্রাম’—বিশ্বজনমত তৈরিতে বড় হাতিয়ার
  • নিখোঁজ: ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২—শহীদ সাংবাদিক ভাই শাহিদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফেরেননি; তাঁর প্রস্থান শিল্পীর আত্মত্যাগের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

একুশের উত্তরাধিকার

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বজুড়ে ভাষা-অধিকার আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ মনে করিয়ে দেয়—ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তিও অসম্পূর্ণ। ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ আর ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি’—এই তিন সুর পর্দায় উঠে আসে সংগ্রামের প্রাণশক্তি হয়ে।

জহির রায়হানের সাহসী চলচ্চিত্রভাষায় ২১ ফেব্রুয়ারির রক্ত ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ একই সুতোয় বোনা। ‘খাঁচা ভাঙব আমি’ গানটি আজো মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা-স্বপ্নের শুরু ভাষার দাবিতে, আর সঙ্গীত-শিল্পী-সাহসী কণ্ঠস্বরে লালিত সংগ্রামই শেষ পর্যন্ত খাঁচা ভাঙার ইতিহাস রচনা করে।

ডেমোক্র্যাটদের নীতির ব্যর্থতা যেভাবে মামদানিকে জয়ী করল

খাঁচা ভাঙব আমি: ২১ ফেব্রুয়ারির আলো ও ‘জীবন থেকে নেয়া’

০৫:০০:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঝরেছিল, সেটি ছিল বাঙালির মুক্তির ইতিহাসের প্রথম স্পষ্ট দাগ। ভাষার অধিকারের সেই দাবিই পরে রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে বিস্তৃত হয়। জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) এই ধারাবাহিকতাকে রূপক ও নাটকীয় ভাষায় তুলে ধরেছে—একদিকে ঘরের স্বৈরতন্ত্র, অন্যদিকে জনতার গণদাবি। এই ফিচারে ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বস্রোত, চলচ্চিত্র-বিশ্লেষণ এবং পরিচালক-লেখক জহির রায়হানের জীবন-কর্ম একসঙ্গে তুলে ধরা হলো।

ভাষা আন্দোলনের ভূমিকমঞ্চ

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পাঁচ বছরের মাথায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের আত্মাহুতিতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। সেই রক্তাক্ত সকালই ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট জয়, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে।

চলচ্চিত্রে প্রতিবাদের প্রতিফলন

  • গল্প আবর্তিত হয় এক দমন-পীড়িত পরিবারকে ঘিরে, যেখানে কর্ত্রীর হাতে তালার চাবি—সদস্যদের বাক্‌স্বাধীনতা ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের রূপক।
  • বাড়ির এই মাইক্রোকসম আসলে সামরিক-শাসিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিচ্ছবি।
  • বাড়ির ভেতরের গোপন গান-মিছিল ও বাইরে জনতার অপ্রতিরোধ্য স্লোগান—দুটি ধারাই দমন-পীড়নের দেয়াল ভেঙে গণজাগরণের পথ চিত্রায়িত করে।

সাউন্ডট্রাকে তিনটি মাইলফলক

  1. ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’—ভাষা-আন্দোলনের আবেগকে দগদগে রাখে।
  2. ‘আমার সোনার বাংলা…’—রবীন্দ্রনাথের গান (আজকের জাতীয় সংগীত) রিকশাযাত্রা ও মিছিলের দৃশ্যে শোনায়, মাটির টান ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উজ্জ্বল করে।
  3. ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি, কেমন করে বাঁচি’—আব্দুল লতিফের বিদ্রোহী সুর ছবির ব্রিজের দৃশ্যে প্রতীকি বন্ধন-ভাঙার আহ্বান হয়ে ওঠে, ভাষা-অধিকার থেকে জাতীয় মুক্তির আকুলতা একাকার করে।

রূপকের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস

চাবি-নির্ভর দমন ভেঙে তালা-চাবির ভাঙন জানিয়ে দেয়, স্বৈরশাসনের কৃত্রিম সীমানা আর টিকছে না। বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে গর্জে ওঠা জনতার মিছিল ও পতাকা ওড়ানো দৃশ্য ভাষা-আন্দোলনের বীজকে ১৯৭১-এর সবুজ-লাল মহীরুহে পরিণত হওয়ার বার্তাই বহন করে।

জহির রায়হান: জীবন ও কর্ম

  • জন্ম: ১৯ আগস্ট ১৯৩৫, ফেনী
  • শিক্ষা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য
  • সাহিত্য: ‘সোনার হরিণ’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’সহ গল্প-উপন্যাস
  • চলচ্চিত্র: ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১), ‘কাজল’ (১৯৬৫), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)
  • মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদান: তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এবারের সংগ্রাম’—বিশ্বজনমত তৈরিতে বড় হাতিয়ার
  • নিখোঁজ: ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২—শহীদ সাংবাদিক ভাই শাহিদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফেরেননি; তাঁর প্রস্থান শিল্পীর আত্মত্যাগের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

একুশের উত্তরাধিকার

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বজুড়ে ভাষা-অধিকার আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ মনে করিয়ে দেয়—ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তিও অসম্পূর্ণ। ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ আর ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি’—এই তিন সুর পর্দায় উঠে আসে সংগ্রামের প্রাণশক্তি হয়ে।

জহির রায়হানের সাহসী চলচ্চিত্রভাষায় ২১ ফেব্রুয়ারির রক্ত ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ একই সুতোয় বোনা। ‘খাঁচা ভাঙব আমি’ গানটি আজো মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা-স্বপ্নের শুরু ভাষার দাবিতে, আর সঙ্গীত-শিল্পী-সাহসী কণ্ঠস্বরে লালিত সংগ্রামই শেষ পর্যন্ত খাঁচা ভাঙার ইতিহাস রচনা করে।