স্যাম রেইনসি
২০২৪ সালে কম্বোডিয়ার মোট আমদানির ৪৯.১ শতাংশই এসেছিল চীন থেকে—মোট ৩.৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০.৯ শতাংশ বেশি। এসব পণ্য ছিল মূলত কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও আধা‑প্রস্তুত পণ্য; বিশেষ করে টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের জন্য অত্যাবশ্যক উপাদান।
তবে চীনের বাজারে কম্বোডিয়ার রপ্তানি নিতান্তই সীমিত, মোট রপ্তানির মাত্র ৫ শতাংশ। বিপরীতে, কম্বোডিয়ার তৈরি পোশাক, জুতো ও ভ্রমণ‑সামগ্রীর মতো পণ্য পশ্চিমা বাজারেই যায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একাই পুরো রপ্তানির ৩৫ শতাংশ গ্রহণ করে। এ অসম বাণিজ্যিক কাঠামো ইঙ্গিত দেয় যে চীনা উপাদানগুলো ক্রমশ কম্বোডিয়ায় প্রক্রিয়াজাত হয়ে ‘কম্বোডিয়ান’ উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে।
এই ত্রিভূজ বাণিজ্য ২০২৪ সালে সংকটাপন্ন হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার সঙ্গে ১২.৩ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড করে—আমদানি ১২.৭ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি ছিল নগণ্য। এ অস্বাভাবিক ঘাটতির কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছর কম্বোডিয়ান পণ্যের ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্ক বসায়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কম্বোডিয়ার এ ঘাটতি একান্তই দ্বিপক্ষীয় নয়; এর উল্টো চিত্র দেখা যায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে। যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তুত পণ্য আমদানি করে, সেগুলোর কাঁচামাল প্রায় পুরোটাই আসে চীন থেকে। মূলত চীনের পণ্যই কম্বোডিয়া ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাচ্ছে, এবং এ পথ চীনা পণ্যের ওপর সরাসরি আরোপিত শুল্কের ধাক্কা অনেকটাই ঠেকিয়ে দিচ্ছে।
দুটি সূত্রের বাণিজ্য‑পরিসংখ্যান তুলনা করলে একটি বড় অমিল ধরা পড়ে। কম্বোডিয়ার শুল্ক বিভাগ জানায়, ২০২৪ সালে তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৭ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য মতে, তারা একই বছর কম্বোডিয়া থেকে ১২.৭ বিলিয়ন ডলার পণ্য আমদানি করেছে—প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। মূল্যায়ন‑পদ্ধতি, শিপমেন্টের সময়‑ব্যবধান বা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে চালান—এসব পরিসংখ্যানগত কারণ কিছু ফারাক তৈরি করলেও, এত বড় ব্যবধান অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
বাণিজ্য‑বিশ্লেষকেরা বহুদিন ধরেই সন্দেহ করছেন, ভুয়া উৎস সনদ দেখিয়ে চীনা পণ্যকে ‘কম্বোডিয়ান’ বলে চালিয়ে শুল্ক‑সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ সালে এমন জালিয়াতি ধরা পড়েছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র ভুল লেবেল লাগানো চীনা স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্য নিয়ে কিছু কম্বোডিয়ান রপ্তানিকারককে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তদারকি জোরদারের আশ্বাস মিললেও, শুল্কের পার্থক্য বড় হওয়ায় এসব ফাঁকি‑ঝুঁকি রয়ে গেছে। এতে ধারণা আরও জোরালো হয় যে চীন শুধু উৎপাদনেই নয়, নিয়ন্ত্রণ এড়াতেও কম্বোডিয়াকে ঢাল করছে।
কম্বোডিয়ার সূতা ও তুলার আমদানি জোগায় চীন, আর স্থানীয় কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামালের প্রায় ৪৫ শতাংশই চীনা। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত হওয়া মাত্র, এসব পণ্য ‘কম্বোডিয়ান’ রপ্তানি হয়ে দাঁড়ায়; যুক্তরাষ্ট্রে কম্বোডিয়ার রপ্তানির ৮৫ শতাংশেরও বেশি পোশাক ও জুতো।
চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো পশ্চিমা বাজারে কম্বোডিয়ার শুল্ক‑সুবিধা কাজে লাগিয়ে সাপ্লাই চেইনের অংশবিশেষ কম্বোডিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরিয়ে নিয়েছে, যেখানে শ্রম সস্তা ও নজরদারি তুলনামূলক ঢিলা। এর ফলস্বরূপ, চীনা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে, বিশেষ করে পোশাকশিল্প ও অবকাঠামো—যেমন ১.৭ বিলিয়ন ডলারের চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত (তবে আপাতত স্থগিত) ফুনান তেচো খাল প্রকল্প।
এ প্রেক্ষাপটে ‘অর্থনৈতিক বিমানবাহী রণতরী’ উপমা যথাযথ: যেভাবে নৌবাহিনীর ক্যারিয়ার নিজের সীমা ছাড়িয়ে শক্তি ছড়ায়, কম্বোডিয়া তেমনি চীনের বাণিজ্য‑শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রক্ষেপণ করছে। ভৌগোলিক অবস্থান, লজিস্টিক সক্ষমতা ও শিথিল নিয়মকানুন—সব মিলিয়ে দেশটি চীনের জন্য শুল্ক এড়ানোর আদর্শ লঞ্চপ্যাড।
তবে এ মডেল ঝুঁকিমুক্ত নয়। কম্বোডিয়ার অর্থনীতি এখন দ্বৈত নির্ভরতার ফাঁদে: কাঁচামাল, মূলধন ও কারিগরি সহযোগিতার জন্য চীনের ওপর, আর রপ্তানি আয়ের বৃহৎ অংশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। দুই অংশীদারের যেকোনো একটির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে, অর্থনীতিতে তীব্র ধাক্কা লাগতে পারে। ৪৯ শতাংশ শুল্কই তার সাম্প্রতিক উদাহরণ।
এই বাণিজ্য‑বিন্যাস কম্বোডিয়ার ভূ‑রাজনৈতিক দ্বিধাও উন্মোচিত করে, বিশেষত হুন সেনের দীর্ঘ ছায়াতলে। ২০২৩ সালে ক্ষমতা পুত্র হুন মানেতকে হস্তান্তর করলেও, হুন সেন এখনো সিনেট ও সিপিপির সভাপতি হিসেবে কলকাঠি নাড়েন। তাঁর অধীনে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর, অথচ রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে চীনের ওপর নির্ভর—যে চীন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমা সমালোচনা থেকে সরকারকে রক্ষা করে।
কিন্তু এই দ্বৈত নির্ভরতা ক্রমেই টেকসই থাকছে না। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক, রাজনৈতিক বৈরিতার পটভূমিতে গড়ে ওঠা রপ্তানি‑নির্ভর মডেলের সীমা স্পষ্ট করে দিয়েছে। একই সময়ে, চীনকেও চটাতে পারবে না সরকার, কারণ বেইজিংকে তারা বন্দুকের নল ধরে থাকা জীবনের বীমা হিসেবে দেখে। ফলে দেশটি দুই শক্তির সংঘাতে পড়ার ঝুঁকিতে।
চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক অগ্রপোস্টে রূপ নেওয়া কম্বোডিয়া দেখায়, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ছোট অর্থনীতির পথ কতটা বাঁকবদল করছে। চীন‑কম্বোডিয়া‑যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিদেশীয় বাণিজ্য‑জাল প্রমাণ করে, অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক কীভাবে ভূ‑রাজনীতির কৌশল হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, কম্বোডিয়ান পণ্যের ওপর শুল্ক সরবরাহ‑শৃঙ্খল জালিয়াতি ও ত্রিভূজ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সতর্ক সংকেত। চীনের জন্য, এটি প্রক্সি‑নীতির সীমাবদ্ধতা, যেখানে বাড়তি নজরদারি ও পাল্টা শুল্ক অপেক্ষা করছে। আর কম্বোডিয়ার জন্য—একটি অংশীদারের কাছ থেকে উৎপাদন, অন্যটির কাছ থেকে ভোগ—এই নিভৃত পন্থা কতটা বিপজ্জনক, তারই ইঙ্গিত।
বিশ্ব বাণিজ্য যখন আরও রাজনৈতিক হয়ে উঠছে, তখন কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোকে ক্রমশ এক পক্ষ বেছে নেওয়ার চাপের মুখে পড়তে হবে—নয়তো মাঝখানে আটকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
লেখক: স্যাম রেইনসি কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টির সহ‑প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত নেতা। তিনি এর আগে কম্বোডিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন।