একটি বৈশ্বিক ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
সারাক্ষণ রিপোর্ট
মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই শিশুদের শিক্ষা ও লালন-পালনের ক্ষেত্রে নারীরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। প্রাচীন সভ্যতা থেকে আধুনিক শ্রেণিকক্ষ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে অনানুষ্ঠানিক সম্প্রদায়ভিত্তিক শিক্ষায়—সবখানেই নারীদেরকে স্বাভাবিক শিক্ষক হিসেবে দেখা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে নারীদের এই শিক্ষাদান ভূমিকার পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইতিহাসের শিকড়: প্রথম শিক্ষক হিসেবে মা
প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতেই মা-ই শিশুর প্রথম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার আগেই, নারীরাই শিশুকে জীবনের মৌলিক দক্ষতা, ভাষা, নৈতিকতা ও সংস্কার শেখানোর দায়িত্ব পালন করতেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল ও প্লেটো পর্যন্ত মায়ের ভূমিকার গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।
কনফুসীয় চীনে, ঘরোয়া শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর চরিত্র ও নৈতিক ভিত্তি গঠনের দায়িত্ব ছিল মায়েদের উপর। একইভাবে আফ্রিকান ও আদিবাসী সমাজগুলোতে নারীরা মৌখিক ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন—প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গল্প, সংস্কৃতির জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস তারা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নারীদের ভূমিকা
সমাজ যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়, তখনও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন:
- ১৯শ শতকের পাশ্চাত্য বিশ্ব: শিল্পবিপ্লবের সময় যখন গণশিক্ষা বিস্তার লাভ করে, নারীরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়ে ওঠেন। সে সময়কার ধারণা অনুযায়ী, নারীরা স্বভাবতই ধৈর্যশীল, স্নেহশীল ও নৈতিকভাবে দৃঢ়—যা শিশুদের গঠনে আদর্শ বলে বিবেচিত হতো।
- গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল বিশ্ব: ঔপনিবেশিকতার অবসানের পর নারীশিক্ষকরা সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে এবং প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখেন। এনজিও ও সরকারগুলো নারীদের শিক্ষকতায় উৎসাহিত করে যাতে লিঙ্গসমতা ও স্কুলে সমাজের আস্থা বৃদ্ধি পায়।
- আধুনিক পরিসংখ্যান:
- ইউনেস্কোর (২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকদের ৯৪% এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের ৬৭%-ই নারী।
- ফিনল্যান্ড-এর মতো দেশে, যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বসেরা, সেখানেও শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ সর্বাধিক।
- বাংলাদেশে, প্রাথমিক ও শিশু শিক্ষায় নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি ও বিদ্যালয়প্রীতি, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে, বৃদ্ধি পেয়েছে।
মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক উপাদান
নারীদেরকে শিশুদের জন্য ভালো শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করার পেছনে কিছু মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক ধারা কাজ করে:
- সহানুভূতি ও যোগাযোগ দক্ষতা: শিশু মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা শিশুদের আবেগ বুঝতে বেশি পারদর্শী, যা কার্যকর শিক্ষা ও আবেগগত সহায়তায় সহায়ক।
- ধৈর্য ও লালনপালনের প্রবণতা: জৈবিক ও সামাজিক প্রশিক্ষণ—উভয় ক্ষেত্রেই নারীরা এই গুণে পরিপূর্ণ, যা শিশুদের শেখানোর জন্য অপরিহার্য।
- রোল মডেল হিসেবে নারী শিক্ষক: অনেক সমাজে শিশু—বিশেষত মেয়েরা—নারী শিক্ষকদের অনুকরণীয় হিসেবে দেখে, যা শেখার আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
চ্যালেঞ্জ ও নারীদের পরিবর্তনশীল ভূমিকা
যদিও প্রাথমিক শিক্ষায় নারীদের আধিক্য রয়েছে, তবুও উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার নেতৃত্বে নারীরা এখনও পিছিয়ে। বর্তমানে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে উঠছে, যার লক্ষ্য নারীদের কেবল প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না রেখে, শিক্ষা নীতি নির্ধারণ, পাঠক্রম উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় নেতৃত্বে নিয়ে আসা।
প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত নারীরা শিশুদের শেখার ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন। সাংস্কৃতিক, জৈবিক ও ঐতিহ্যগতভাবে তাদের অবদান আজও বিশ্বজুড়ে প্রজন্ম গঠনে কার্যকর। যদিও নারী-পুরুষ সমতার দিকে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে, শিশু শিক্ষায় নারীদের প্রাকৃতিক সংযুক্তি একটি চিরন্তন ও প্রভাবশালী বাস্তবতা হয়ে রয়ে গেছে।