সারাক্ষণ রিপোর্ট
“রিকশা চালাই, কারণ বাচ্চারে না খাইয়ে রাখতে পারি না”
হাসিনা বেগম, বয়স ৩৫, ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় থাকেন। স্বামী ফেলে গেছে সাত বছর আগে, রেখে গেছে দুই ছেলে-মেয়ে। প্রথমে বাসাবাড়িতে কাজ করতেন, পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই কাজও আর করতে পারেননি। তিন বছর ধরে তিনি চালাচ্ছেন রিকশা।
“প্রথম দিন যখন রাস্তায় নামলাম, লোকজন তাকিয়ে ছিল—কে এই মহিলা? কেউ কেউ খিস্তিও দিছিল। কিন্তু আমি ভাবলাম, খাবার জোগাড় করাটাই মুখ্য, কে কী বলল, তাতে কি পেট ভরে?”
সন্তানের মুখের হাসির জন্যই সংগ্রাম
হাসিনার ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। দুজনকেই স্কুলে রেখেছেন বড় কষ্টে। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে আয় হয় গড়ে ৪০০–৫০০ টাকা। এর মধ্যে ২০০ টাকা যায় রিকশা ভাড়ায়, ১০০–১৫০ টাকা খরচ হয় বাসায় চাল-ডাল কিনতে।
“শুধু একটা চাওয়া—বাচ্চাদের যেন আমার মতো জীবন না হয়। ওরা যেন স্কুল ছাড়তে না হয় কষ্টে পড়ে।”
প্রতিদিন ভোরে শুরু, রাতে ফিরলে ভাঙা শরীর
হাসিনা প্রতিদিন সকাল ৬টায় বেরিয়ে পড়েন, চালান মধ্যবিত্ত পাড়া—খিলগাঁও, তিলপাপাড়া, মুগদা এলাকায়। পুরুষ চালকদের সাথে প্রতিযোগিতা করেই চালাতে হয়।
“অনেকে হাসে, কেউ আবার বলে—‘বাসায় থাকেন, রিকশা মেয়েদের কাজ না’। আমি বলি, আমি ভিক্ষা করি না, কাজ করি।”
তাঁর হাতের চামড়া মোটা হয়ে গেছে রিকশার হ্যান্ডেল ঘোরাতে ঘোরাতে, পায়ে প্রায়ই টান ধরে। কিন্তু থামা মানেই না খেয়ে থাকা।
একা নারী, অনেক ভয়
সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হন না। বহুবার কটূক্তি, অশালীন প্রস্তাব, এমনকি হুমকিও শুনেছেন।
“রিকশায় উঠেই কেউ বলছে, ‘রাইতে দেখা হবে নাকি?’—তখন বলি, আমি মা, আমি চালক, আমি কেউর কিছু না। তবু ভয় পাই ভাই, রাত হলে ফিরি তাড়াতাড়ি।”
সাহসের প্রতীক, কিন্তু সহায়তা নেই
সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা তাকে সাহায্য করেনি। হাসিনা চান—মহিলাদের জন্য রিকশা চালানোকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, তাঁদের জন্য নিরাপত্তা ও রিকশা মালিকানা সহজ করা হোক।
“একটা নিজের রিকশা পেলে অন্তত ভাড়ার চিন্তা থাকত না। মহিলা চালকদের জন্য আলাদা সংগঠন থাকলে ভালো হতো।”
নারী চালকেরা শুধু চালক নন—তাঁরা সংগ্রামের প্রতীক
ঢাকার অলিতে-গলিতে পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে চলছে হাসিনা বেগমের মতো নারীরা। তাঁদের গল্প শুধু দুঃখ নয়, এক সাহসিকতার ইতিহাস। সমাজ যদি তাঁদের গ্রহণ করে ও সহায়তা করে, তাহলে আরও অনেক হাসিনা সামনে এগিয়ে আসতে পারবে।