ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলের ওপর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রশিক্ষণ বিমান ভেঙে পড়ে অনেক সংখ্যক (যেহেতু প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এখনও কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জানায়নি) শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। শিশু মৃত্যু পৃথিবীতে সব থেকে হৃদয়বিদারক ঘটনা। তারপরেও বাস্তবতা হলো দুর্ঘটনা কেউ এড়াতে পারে না। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগেই এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন ক্র্যাশে ২৬০ জন মানুষ মারা গেছেন। তার ভেতর নবদম্পতি থেকে শিশুও ছিল। কিন্তু যা দুর্ঘটনা—তা তো দুর্ঘটনাই।
এ কারণেই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বিষয় ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট। অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শুধু নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমেরিকার থেকেও বাংলাদেশি প্রশাসন তাদের যোগ্যতার প্রমাণ ইতোমধ্যে দিয়েছে। যেমন নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বন্যা হয় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শুধু মালদহ ও কিছু এলাকায় বন্যা হয়। জাতিসংঘের একটি সংস্থা বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে মন্তব্য করেছিল, বিপুল সংখ্যক মৃত্যু হবে, খাদ্য সরবরাহে বাধা হবে। বাংলাদেশের প্রশাসন ওই ধারণা শতভাগ মিথ্যা প্রমাণ করেছিল। বরং কত যে উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি প্রশাসনের মানুষরা সরবরাহ চেইন চালু রেখেছিল তা নিয়ে অনেক বড় বই লেখা যায়। অথচ ছয় মাসেও মালদহ পানি নামাতে পারেনি। সেখানে পানিবাহিত রোগও হয় অনেক ধরনের। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ যেভাবে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ম্যানেজমেন্ট করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। এমনকি ফ্লোরিডায় ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পরে অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া লিখেছিল, এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ম্যানেজমেন্ট করার জন্য তাদের বাংলাদেশকে অনুসরণ করা উচিত ছিল। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরে সেনাবাহিনী, র্যাব, ফায়ার ব্রিগেড, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও এনাম মেডিকেলের মতো একটি ছোট শহরের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল যেভাবে কাজ করেছিল—তা ছিল একটি দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের এই প্রশাসনিক দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কেন মাইলস্টোনের দুর্ঘটনার পরে প্রশাসনকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেল না? কেন দেশে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট ও ঘটনাস্থল দিয়াবাড়ি থেকে সরাসরি মেট্রোরেল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সে সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলো না? কেন বা দ্রুত প্রশাসনের সেই অংশকে সেখানে পাঠানো হলো না যারা পানি, ছোট যানবাহন—যা যা ওই মুহূর্তে লাগবে—সেগুলো দ্রুত ব্যবস্থা করতে পারে। কেন ভুক্তভোগিদের ক্ষোভ যা শুনতে হচ্ছে, ৫০ টাকার ছোট যানবাহনের ভাড়া তাদেরকে ৫০০ টাকা দেওয়া লেগেছে! ৬০ টাকার পানি কেন তাদেরকে ছয়শ টাকায় কিনতে হয়েছে?
এর মূল কারণ প্রকৃত প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে সেখানে কাজে লাগানো হয়নি—আর সব দেশে এমন দুর্যোগে প্রশাসনকে যারা সব থেকে বেশি সাহায্য করে সেই সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে কাজে লাগানো হয়নি।
সরকার কেন এ ভুল করেছে তা নিয়ে ভবিষ্যতে বিশ্লেষণ করলে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা যাবে। তবে আপাত এটাই বলা যায়, সরকারের এই ভুল হয়েছে বা এ ব্যর্থতার মূলে তাদের নার্ভাসনেস। কারণ মাইলস্টোন স্কুলের এই দুর্ঘটনার আগের প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সরকারের কিংস পার্টির কয়েকটি ছেলেকে নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে—সরকার গোপালগঞ্জে যা করেছে তা গোটা বিশ্ব দেখেছে। বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে। সরকারের কেউ কেউ গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষকে আগের সরকারের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই কিংস পার্টির ছেলেদের প্রতি কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলায় সাধারণ মানুষ একই আচরণ করার পরে, স্বাভাবিকভাবে সরকার নার্ভাস হয়ে পড়েছে।
যে নার্ভাসনেস থেকে দেখা গেছে তাদের কাজের চরম সমন্বয়হীনতা ও এক ধরনের জনগণকে সবকিছু না জানানোর একটি প্রবণতা। কোনো সরকার কোনো জাতীয় দুর্ঘটনা নিয়ে যখন নিজের ভেতরের দুর্বলতা থেকে নার্ভাস হয়ে পড়ে এবং জনগণকে লুকাতে চায়—তখনই মানুষ ক্ষুব্ধ হয়, অন্যদিকে ব্যবস্থাপনাও ভেঙে পড়ে। তাছাড়া সরকারের হাতে গোনা কয়েকজন উপদেষ্টা তো নিজে হাতে এ দুর্ঘটনা সামাল দিতে পারবে না, এ কাজে প্রশাসনকে পূর্ণ দায়িত্ব দিতে হবে। প্রশাসনের সকলেই এ দেশের সন্তান। যে কোনো দুর্ঘটনায় সকলকেই তাঁর দেশের জন্য কাজ করতে হয়। সেখানে দলমত থাকে না। তাছাড়া মৃত্যু বা দুর্ঘটনায় এ মাত্র পাপিষ্ঠ ছাড়া কেউই দলমত দেখে না। আর এ ধরনের পাপিষ্ঠ একটি দেশে হাতে গোনা কয়েকজন থাকে। প্রশাসনে যারা আছেন, তাদের সকলেরই সন্তান আছে, পিতা, মাতা ও স্ত্রী আছেন—তাই তারা এ দুর্ঘটনার সময় সকল কিছুই তাদের নিজের পরিবারের অংশ মনে করেই কাজ করেন। সাংবাদিক হিসেবে গত প্রায় ৪৭ বছরের বেশি প্রশাসনের মানুষদেরকে তো দেখে আসছি। শিখেছিও তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু।
তাই অনেকটা আস্থা নিয়েই বলতে পারি—যথা প্রশাসনের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে একদিকে যেমন আহতদের চিকিৎসা, নিহতদের সৎকার ও শোকদিবস পালনের যাবতীয় প্রথা—অর্থাৎ পতাকার অবস্থান, স্কুল-কলেজ বন্ধ, কালো ব্যাজ ধারণ—সহ সব কিছুই ঠিকঠাক মতো হতো। এত বড় দুর্ঘটনার পরের দিন দেশের রাস্তায় ক্ষুব্ধ সন্তানদের ওইভাবে পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হতো না। যে পুলিশ বাধ্য হয়ে লাঠি পেটা করেছে সেও মনে মনে দুঃখিত হয়েছে, কারণ সেও একজন ভাই না হয় পিতা। ওই শোকের দিনে তারও মানসিকতা এ কাজের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তাকে শুধু সরকারের আদেশ মানতে হয়েছে।
আর এত বড় দুর্ঘটনার পরে রাজপথে ওই অবস্থা হয়েছিল শুধুমাত্র সরকারের নার্ভাসনেস ও অব্যবস্থাপনা থেকে। এবং সে অব্যবস্থাপনা ও নার্ভাসনেস যে কত বড় আকারের তার প্রমাণ সরকার বিকেলে তিনটি নিবন্ধিত ও একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যে বৈঠক করে- সেই বৈঠকের ছবিই সবটুকু প্রকাশ করে দেয়।
একটি শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে—সেখানে সরকারের কারো পোশাকে একটি কালো ব্যাজ ছিল না। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনায় এত শিশুর মৃত্যুর জন্য যে শোকদিবস—এই শোকদিবসে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিটিং-এ এত ভোজের আয়োজন থাকে কীভাবে? এবং ওই ভোজের সামনে বসে থাকাদের মধ্যে টিভি পর্দায় একমাত্র মির্জা ফখরুলের গম্ভীর মুখ ও খাবার দূরে রাখার দৃশ্য ছাড়া কিছু তরুণকে যেভাবে খেতে দেখা গেছে তা অনেকটা অশ্লীল। হতে পারে, ভালো খাবার তাদের সামনে, কিছুদিন আগেও এদের খাবারের মেনু কী ছিল তা দেশবাসী সামাজিক মাধ্যমে দেখেছে—তাই মির্জা বাড়ির ছেলের মতো তাদের পক্ষে ভালো খাবারকে দূরে ঠেলে দেওয়াটা সম্ভব নয়। এ কারণে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভুল তাদেরই—যারা একটি শোকের দিনের বৈঠকে এতটা খাবারেরও আয়োজন করেছেন।
আর অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা শোক দিবসের একটি আলোচনায় বসে যেভাবে তার মুখে হাসির ছটা বার বার ছড়িয়ে দিতে থাকেন—যা টেলিভিশনের ক্যামেরায় গোটা দেশ দেখেছে—এর পরে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
মৃত্যুর পরে এই খাবার ও খাবার ঘিরে আনন্দ হিন্দু সমাজের একটি কুসংস্কার হিসেবে এখনও আছে। তবে ভারতের কয়েকটি রাজ্য ইতোমধ্যে এটা আইন করে শুধু নিষিদ্ধ নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনের অধীনে এনেছে।
সরকার প্রধান ও তার সহকর্মীরা অনভিজ্ঞ রাষ্ট্র পরিচালনায়—কিন্তু তারা তো সামাজিক মানুষ। পরিবারের মানুষ। তাই এই হাসি, এই খাদ্য এদিনে মানায় না—এটা তো তাদের বোঝা উচিত ছিল।
পাশাপাশি কিছু রাজনীতিকরা যেভাবে কর্মীসহ সদলবলে বার্ন ইউনিটে গেলেন—তারা প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে এসে আজ এ পরিণত বয়সে এ কাজ কীভাবে করলেন?
প্রথমত রাজনীতিক নেতাদের বার্ন ইউনিটে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। তারা তাদের কর্মী নিয়ে যাবেন উদ্ধার কাজে। আর মেডিকেটেড এপ্রন ছাড়া বার্ন ইউনিটে কি ঢোকা উচিত?
বাস্তবে সব আচরণ দেখে আবার কখনও কখনও নিজের দিকে তাকিয়েও মনে হয়, আমরা সকলে বা গোটা রাষ্ট্র ও সমাজ কি কোনো মানসিক অসুস্থতায় ভুগছি। যেমন সরকারের দিনের কাজ রাতে হয়—আজকাল, অধিকাংশের রাতের ঘুম দিনে হয়। ঠিক তেমনি সরকারি একটা অতিথি ভবনে ঢুকে মিটিং করার জন্য মির্জা ফখরুল ইসলাম, আমীর খসরু মাহমুদদের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদদের গলায় সার্বক্ষণিক সরকারি কার্ডটি ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
একজন ক্ষুদ্র সাংবাদিক হিসেবে এ দেশের অনেক সরকার প্রধানের সঙ্গে একক মিটিংয়ে দেখা করেছি—বিদেশেরও অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি। সেখানেও কার্ড একটি দেয় ঠিকই কিন্তু সেটা প্রটোকল অফিসারের হাতেই থাকে। আর সেখানে কি ওই দিন স্কুলের ঘটনাই সবার মাথায় ছিল বলে কালো ব্যাজ না পরলেও সরকারি লোকেরা দেশের প্রবীণ দুজন সম্মানিত রাজনীতিবিদের গলায় স্কুলের ছাত্রের মতো কার্ড ঝুলিয়ে দিলেন?
আবার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে ছাত্র মৃত্যুর শোক নিয়ে একটি শব্দ নেই। আসলে এ মুহূর্তে আমাদের সমস্যা কোথায়—মাথায়, না সিস্টেমে—না, অন্য কোথায়? এটা খোঁজা ও এ সমস্যা যত দ্রুত শেষ করা সম্ভব- সেটাই কি জরুরি নয়?
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.