প্রাচীন গর্জনের উত্তরাধিকার
সুন্দরবনের গহীনে এক নিঃশব্দ অথচ দৃপ্ত পদচারণার নাম—রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এর বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris tigris, যা পৃথিবীর বৃহত্তম বাঘ প্রজাতিগুলোর একটি। গর্জনে কম্পমান এই প্রাণী বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, এবং প্রকৃতির খাদ্যচক্রে শীর্ষস্থানে থাকা এক নিরবচেতন প্রহরী।
বাসস্থান: গহন ম্যানগ্রোভের রাজত্ব
বেঙ্গল টাইগারদের মূল আবাস সুন্দরবন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই বন। এখানে নোনা জল, কেওড়া‑গড়ান‑গরান গাছ, কাঁকড়াভরা মাটিতে ঘুরে বেড়ায় এই দুর্ধর্ষ শিকারিরা। সুন্দরবনের এমন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে হলে এদের হতে হয় নিখুঁত অভিযোজিত।
সংখ্যা ও সংকট
২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১১৪টি। সংখ্যাটি আশাব্যঞ্জক নয়, কারণ বিগত তিন দশকে এদের সংখ্যা কমে এসেছে অর্ধেকেরও বেশি। প্রধান হুমকিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বন উজাড় ও জনবসতি সম্প্রসারণ
- চোরা শিকার ও পাচার
- জলবায়ু পরিবর্তন (লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়)
- মানুষ-পশু সংঘাত
শিকার কৌশল ও খাদ্যাভ্যাস
বেঙ্গল টাইগার সাধারণত একা শিকার করে এবং দিনে প্রায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার এলাকা টহল দেয়। এদের প্রধান শিকার হরিণ, বুনো শূকর, কচ্ছপ, কাঁকড়া ইত্যাদি। যদিও বাঘ মাংসাশী, তবে ক্ষেত্রবিশেষে কাঁকড়া বা এমনকি মাছও খেতে দেখা গেছে।
বাঘের চোখ রাতে উজ্জ্বল হয়, শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ, আর লাফানোর ক্ষমতা অতুলনীয়। একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ ২০ ফুট পর্যন্ত এক লাফে শিকার ধরতে পারে।
বাঘ ও মানুষ: সংঘাত না সহাবস্থান?
বছরে গড়ে ৮–১০টি বাঘের সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ ঘটে, বিশেষ করে বনজীবীদের সঙ্গে। অনেক সময় বাঘ গ্রামের আশেপাশে চলে আসে, গরু বা ছাগল ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়, এবং প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মানুষ বাঘ হত্যা করে বসে। অথচ এ সংঘাতের মূল কারণ বন নিধন এবং খাদ্যের সংকট।
সংরক্ষণ উদ্যোগ: কতটা কার্যকর?
সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন:
- বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প (Tiger Action Plan)
- বাঘ গণনা প্রযুক্তির আধুনিকায়ন (Camera trap survey)
- টহল ব্যবস্থা জোরদার ও চোরাশিকার রোধে ‘স্মার্ট প্যাট্রোল’
- স্থানীয় জনগণের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
তবে বাস্তব চিত্র বলছে, তহবিল ও জনবল ঘাটতি, দুর্নীতি এবং প্রকৌশল নির্ভর উন্নয়ন পরিকল্পনা অনেক সময় উল্টো বাঘের ক্ষতি করছে।
জাতীয় প্রতীক হিসেবে গুরুত্ব
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে চেতনা ছিল, তার প্রতীক ছিল বাঘের মতো সাহস। সেই ঐতিহ্য থেকেই বাঘ আমাদের জাতীয় পশু। কিন্তু আজ সেই বাঘই যদি বিলুপ্তির মুখে পড়ে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে—আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শুধুই পাঠ্যবইয়ের ছবি দেখিয়ে বলব, “এই ছিল আমাদের বাঘ”?
রয়েল বেঙ্গল টাইগার শুধু সুন্দরবনের নয়, বাংলাদেশের অহংকার। এরা বেঁচে থাকলে আমাদের বন বাঁচে, বন বাঁচলে বাঁচে নদী, নদী বাঁচলে বাঁচে জনপদ। তাই এই বাঘের অস্তিত্ব শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয় নয়, এটি আমাদের পরিবেশগত টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক।