১০:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
কোয়াড সম্প্রসারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য যোগদানের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও থাই-ক্যাম্বোডিয়ান সীমান্তে সংঘর্ষ অব্যাহত হিউএনচাঙ (পর্ব-১৫৭) রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৫) শিক্ষার বাতিঘর প্রয়াত প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকীর ৫৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন ‘জেন জি’ তরুণরা অধিকাংশ ডানপন্থী রাজনীতি করে: সমস্যা প্রেমে ও ডেটে যুক্তরাষ্ট্র-হামাস আলোচনায় অচলাবস্থা, গাজা ও ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে কূটনৈতিক ব্যস্ততা নদীতে ভাসমান হাট: বরিশাল ও ঝালকাঠির নৌপথে কৃষিপণ্যের জীবন্ত সংস্কৃতি চিতা বাঘ — ছায়ায় লুকিয়ে থাকা বনবাসী যুক্তরাজ্যের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেল ভারত : বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

আধুনিক জীবন ও উদারচিন্তা ভয়ের পরিবেশে: বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা

আতঙ্কের ছায়া কেন?

বাংলাদেশের অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী সাম্প্রতিক সময়ে একটি অদ্ভুত ভয়ের কথা জানাচ্ছেন—তাঁরা আতঙ্কিত, কারণ তাঁদের চিন্তা-চেতনা মুক্ত ও জীবনধারা আধুনিক। তাঁরা রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ছায়ানটের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা আর্ট গ্যালারিতে যাওয়াকে জীবনের স্বাভাবিক ও সুন্দর অংশ মনে করেন। কিন্তু আজ, এই জীবনধারাই কিছু মানুষের চোখে ‘অপরাধ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

আধুনিকতা ও উদারতা: সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই দেশে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লালন, জসীমউদ্দীনের কবিতা বা ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিষয় নয়—এগুলো আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ। ছায়ানট বহু দশক ধরে বৈশাখ উদযাপন, সংগীত শিক্ষা এবং মূল্যবোধের চর্চার এক প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু আজ এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকাই কিছু মানুষের কাছে ‘নির্বাচিত অপরাধ’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আক্রমণাত্মক মনোভাব

ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, এক্স (পূর্বতন টুইটার) সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এখন কিছু সংগঠিত গোষ্ঠী উদারপন্থী, নারীবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ বা কেবলমাত্র আর্ট-কালচারে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কটাক্ষ, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কেউ রবীন্দ্রসংগীত গাইলেই, কোনো নারী আধুনিক পোশাকে ছবি পোস্ট করলেই কিংবা কেউ ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ নিয়ে কথা বললেই তাঁকে “ধর্মবিরোধী”, “পশ্চিমা দালাল”, এমনকি কখনো কখনো “জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি” হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

এই প্রচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকেই তাঁদের ব্যক্তিগত পোস্ট মুছে ফেলছেন, ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা এখন গানের অনুষ্ঠান বা আর্ট এক্সিবিশনে যাওয়ার আগে দু’বার ভাবেন।

রাজনীতির মেরুকরণ ও ধর্মীয় উগ্রতার উত্থান

এই ভয়ের পেছনে একটি বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ধর্মীয় উগ্রতার প্রসার। একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের পরিচিতি ও ইতিহাসকে ধর্মীয় কট্টরতার লেন্সে দেখার চেষ্টা করছে। এই গোষ্ঠী উদারপন্থী সংস্কৃতিকে ‘ধর্মদ্রোহিতা’ বা ‘পশ্চিমা প্রভাব’ বলে অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ফলে যারা নিজেকে কেবলমাত্র শিল্প, সংগীত, সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে দেখাতে চায়, তারাও এখন ‘টার্গেট’ হয়ে পড়ছে।

নারীদের ক্ষেত্রে ভয় আরও তীব্র

আধুনিক জীবনধারার নারীরা, যারা পেশাগত জীবন, শিল্প-সাহিত্য, ফ্যাশন বা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের জন্য সামাজিক মাধ্যম এখন এক প্রকার মানসিক নির্যাতনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। নারীর পোশাক, মতামত, জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে যেভাবে কুৎসা রটানো হয়, তা শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, জীবনযাপনও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ফলে অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।

শিল্প-সংস্কৃতির উপর নীরব আক্রমণ

ছায়ানট, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, ব্রিটিশ কাউন্সিল—এইসব প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ সংগীত, চারুকলা ও নাটকের চর্চা করে, সেখানেও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এখনো হামলা হয়নি বটে, কিন্তু পরিবেশটি যেন ক্রমে বন্ধ্যাত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তরুণ শিল্পীরা বলছেন, তাঁদের প্রকাশিত গান বা চিত্র নিয়ে অনলাইন হেনস্তার অভিজ্ঞতা তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় আঘাত করছে।

রাষ্ট্রের নীরবতা: নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এই বিভ্রান্তিকর প্রচার ও অনলাইন আক্রমণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এতে মানুষ মনে করছেন, এই ঘৃণার বিরুদ্ধে তাঁরা একা, নিরুপায়। এক সময় যাঁরা বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ একটি মুক্তচিন্তার দেশ, আজ তাঁরাই বলছেন—“আমরা কি আর সত্যিই নিরাপদ?”

সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সর্বদা বহুবাচনিক, মানবিক ও উদার ছিল। আজ যারা এই মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তাঁদের দমন করার প্রচেষ্টা চললেও, তার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক ও আইনি কাঠামোর ভেতর থেকেই। সাহস, সংহতি এবং সচেতন প্রতিরোধই হতে পারে এই আধুনিক ও মুক্তচিন্তার সমাজের নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার।

কোয়াড সম্প্রসারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য যোগদানের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব

আধুনিক জীবন ও উদারচিন্তা ভয়ের পরিবেশে: বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা

১২:২১:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

আতঙ্কের ছায়া কেন?

বাংলাদেশের অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী সাম্প্রতিক সময়ে একটি অদ্ভুত ভয়ের কথা জানাচ্ছেন—তাঁরা আতঙ্কিত, কারণ তাঁদের চিন্তা-চেতনা মুক্ত ও জীবনধারা আধুনিক। তাঁরা রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ছায়ানটের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা আর্ট গ্যালারিতে যাওয়াকে জীবনের স্বাভাবিক ও সুন্দর অংশ মনে করেন। কিন্তু আজ, এই জীবনধারাই কিছু মানুষের চোখে ‘অপরাধ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

আধুনিকতা ও উদারতা: সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই দেশে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লালন, জসীমউদ্দীনের কবিতা বা ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিষয় নয়—এগুলো আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ। ছায়ানট বহু দশক ধরে বৈশাখ উদযাপন, সংগীত শিক্ষা এবং মূল্যবোধের চর্চার এক প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু আজ এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকাই কিছু মানুষের কাছে ‘নির্বাচিত অপরাধ’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আক্রমণাত্মক মনোভাব

ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, এক্স (পূর্বতন টুইটার) সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এখন কিছু সংগঠিত গোষ্ঠী উদারপন্থী, নারীবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ বা কেবলমাত্র আর্ট-কালচারে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কটাক্ষ, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কেউ রবীন্দ্রসংগীত গাইলেই, কোনো নারী আধুনিক পোশাকে ছবি পোস্ট করলেই কিংবা কেউ ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ নিয়ে কথা বললেই তাঁকে “ধর্মবিরোধী”, “পশ্চিমা দালাল”, এমনকি কখনো কখনো “জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি” হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

এই প্রচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকেই তাঁদের ব্যক্তিগত পোস্ট মুছে ফেলছেন, ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা এখন গানের অনুষ্ঠান বা আর্ট এক্সিবিশনে যাওয়ার আগে দু’বার ভাবেন।

রাজনীতির মেরুকরণ ও ধর্মীয় উগ্রতার উত্থান

এই ভয়ের পেছনে একটি বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ধর্মীয় উগ্রতার প্রসার। একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের পরিচিতি ও ইতিহাসকে ধর্মীয় কট্টরতার লেন্সে দেখার চেষ্টা করছে। এই গোষ্ঠী উদারপন্থী সংস্কৃতিকে ‘ধর্মদ্রোহিতা’ বা ‘পশ্চিমা প্রভাব’ বলে অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ফলে যারা নিজেকে কেবলমাত্র শিল্প, সংগীত, সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে দেখাতে চায়, তারাও এখন ‘টার্গেট’ হয়ে পড়ছে।

নারীদের ক্ষেত্রে ভয় আরও তীব্র

আধুনিক জীবনধারার নারীরা, যারা পেশাগত জীবন, শিল্প-সাহিত্য, ফ্যাশন বা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের জন্য সামাজিক মাধ্যম এখন এক প্রকার মানসিক নির্যাতনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। নারীর পোশাক, মতামত, জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে যেভাবে কুৎসা রটানো হয়, তা শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, জীবনযাপনও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ফলে অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।

শিল্প-সংস্কৃতির উপর নীরব আক্রমণ

ছায়ানট, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, ব্রিটিশ কাউন্সিল—এইসব প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ সংগীত, চারুকলা ও নাটকের চর্চা করে, সেখানেও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এখনো হামলা হয়নি বটে, কিন্তু পরিবেশটি যেন ক্রমে বন্ধ্যাত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তরুণ শিল্পীরা বলছেন, তাঁদের প্রকাশিত গান বা চিত্র নিয়ে অনলাইন হেনস্তার অভিজ্ঞতা তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় আঘাত করছে।

রাষ্ট্রের নীরবতা: নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এই বিভ্রান্তিকর প্রচার ও অনলাইন আক্রমণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এতে মানুষ মনে করছেন, এই ঘৃণার বিরুদ্ধে তাঁরা একা, নিরুপায়। এক সময় যাঁরা বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ একটি মুক্তচিন্তার দেশ, আজ তাঁরাই বলছেন—“আমরা কি আর সত্যিই নিরাপদ?”

সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সর্বদা বহুবাচনিক, মানবিক ও উদার ছিল। আজ যারা এই মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তাঁদের দমন করার প্রচেষ্টা চললেও, তার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক ও আইনি কাঠামোর ভেতর থেকেই। সাহস, সংহতি এবং সচেতন প্রতিরোধই হতে পারে এই আধুনিক ও মুক্তচিন্তার সমাজের নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার।