বরিশালের গর্ব: দেশের পেয়ারা রাজধানী
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ জেলা বরিশাল, শুধু নদ-নদী ও বৃষ্টি-বাতাসের জন্য নয়, দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত পেয়ারা উৎপাদন অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। এই জেলাকে অনেকে মজার ছলে বলেন “পেয়ারা জেলা”। বরিশালের স্বাদে ভরা রসালো পেয়ারা দেশজুড়ে জনপ্রিয়, আর এই জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে এক অনন্য কৃষিপরিবারের ইতিহাস ও জীবিকার সংগ্রাম।
উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র: ভীমরুলি, জয়শ্রী ও আটঘর
বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, আগৈলঝাড়া, বাবুগঞ্জ, কাউখালী ও ঝালকাঠির অন্তর্গত কিছু অংশে বিশেষ করে ভীমরুলি, জয়শ্রী ও আটঘর এলাকায় পেয়ারা চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। এই অঞ্চলগুলোতে বিস্তীর্ণ জমিতে সারি সারি গাছ সাজানো পেয়ারাবাগান চোখে পড়ে। শুধু জমিতে নয়, বর্ষাকালে নৌপথে বাজার বসে। ‘ভাসমান পেয়ারার হাট’ নামে পরিচিত এই বাজারগুলো বরিশালের কৃষিপণ্যের অনন্য ঐতিহ্য তুলে ধরে।
বর্ষা মানেই ভাসমান হাট
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বরিশালের নদী ও খালে ভাসমান হাট বসে। নৌকায় করেই কৃষকরা নিয়ে আসেন নিজেদের বাগানে উৎপাদিত পেয়ারা। নদীর ওপর কাঠ বা টিনের ছাউনি দেওয়া কোনো স্থায়ী কাঠামো নেই, পুরো হাটটাই নৌকাভিত্তিক। পাইকাররা এসে এখান থেকেই পেয়ারা কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান। দেশের এমন অভিনব বাজার বিশ্বের খুব কম জায়গায়ই দেখা যায়।
জলবায়ু ও মাটি: উৎপাদনের মূল কারিগর
বরিশালের পলিমাটি ও আর্দ্র জলবায়ু পেয়ারা চাষের জন্য একেবারে আদর্শ। বর্ষাকালেই এখানে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা হয়। এখানকার পেয়ারা গাছে স্বাভাবিকভাবেই রোগবালাই কম হয় এবং একবার বাগান তৈরি হলে দশ থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। কৃষকরা সাধারণত দেশি জাতের পেয়ারা চাষ করেন, তবে সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের জাত পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
অর্থনীতি ও জীবিকা
পেয়ারা চাষ বরিশালের হাজার হাজার কৃষক পরিবারের জীবিকার মূল ভিত্তি। অনেক পরিবার এখন শুধু পেয়ারা চাষ করেই স্বচ্ছল হয়েছে। স্থানীয় যুবকদের অনেকেই উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরির সন্ধানে না গিয়ে পেয়ারা বাগান গড়ার দিকে ঝুঁকছে। এক বিঘা জমিতে গড়ে বছরে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি সম্ভব, যা অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক।
চ্যালেঞ্জ: সংরক্ষণ ও মূল্য স্থিতিশীলতা
বরিশালের পেয়ারা চাষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সংরক্ষণের অভাব। এখনও পর্যন্ত এখানে কোনো আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ নেই। ফলে পেয়ারা তুলেই দ্রুত বিক্রি করতে হয়, না হলে নষ্ট হয়ে যায়। আবার বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে দাম পড়ে যায়, এতে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
সম্ভাবনার দিগন্ত: রপ্তানি ও শিল্পায়ন
বরিশালের পেয়ারা রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও বাংলাদেশের পেয়ারার স্বাদ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন প্যাকেজিং, মান নিয়ন্ত্রণ এবং সংরক্ষণ সুবিধার আধুনিকীকরণ। পাশাপাশি পেয়ারাভিত্তিক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুললে স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
সবুজ ঐতিহ্যের টিকে থাকা
বরিশালের পেয়ারা কেবল একটি ফল নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি জীবিকা, একটি পরিচয়। এই অঞ্চলের নদী ও মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সবুজ ফলটি। পরিকল্পিতভাবে এর উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে, বরিশালের পেয়ারা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবেও পরিচিত হতে পারে।