১২:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহযোগিতায় নতুন দিগন্ত মার্ক উড আশ্বাস দিলেন, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার কটাক্ষ সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাসী ইংল্যান্ড দল তাপ থেরাপিতে রক্তচাপ কমানোর আশার আলো: নতুন গবেষণায় চমকপ্রদ ফলাফল জাকার্তার মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণ: আতঙ্কে শহর, আহত ৫৫ জন গাজায় বর্জ্য সংকট: দূষণে ডুবে স্বাস্থ্য বিপর্যয় তানজানিয়ায় রক্তে রাঙানো দমন-পীড়ন: এক ভয়াবহ নতুন বাস্তবতা ভারতের অদ্ভুত স্থিতিশীলতা একক জীবন: বৈশ্বিক এককতা বৃদ্ধির কারণ এবং প্রভাব স্ট্র্যাটেজিক অজ্ঞতা: ডোনাল্ড ট্রাম্পের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভ্রান্তি মানসিক স্বাস্থ্য: আমেরিকার মডেল মোবাইল সংকট সেবার উত্থান ও পতন

রওশন জামিল — চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও নৃত্যজগতের আলোকবর্তিকা

শিল্পের সেবায় এক জীবন

বাংলা নাটক, চলচ্চিত্র ও নৃত্যকলার ইতিহাসে কিছু নাম সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠে কালজয়ী। তেমনি একজন শিল্পী ছিলেন রওশন জামিল। নৃত্যশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন অসাধারণ অভিনেত্রী ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে। তাঁর প্রজ্ঞাময় উপস্থিতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও আবেগের মূর্ত প্রতীক।

জন্ম ও শৈশব: সাংস্কৃতিক পথের সূচনা

রওশন জামিল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ৮ মে, ঢাকা শহরের রোকানপুরে। তাঁর পিতা ছিলেন আবদুল করিম। শৈশব থেকেই তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি নারীশিক্ষা ও নৃত্যচর্চার পথে এগিয়ে যান দৃঢ়তার সঙ্গে। স্কুলজীবন কাটে ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল ও পরে ইডেন মহিলা কলেজে।

গওহর জামিলের সঙ্গে জীবন ও শিল্পের জুটি

নৃত্যশিক্ষার পথেই তাঁর পরিচয় হয় খ্যাতিমান নৃত্যগুরু গণেশ নাথের সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গওহর জামিল নাম নেন। তাঁরা ১৯৫২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৯ সালে দুজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের প্রথম নৃত্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘জাগো আর্ট সেন্টার’—যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর।

টেলিভিশন ও নাট্যজগতে পদচারণা

রওশন জামিলের নাট্য জীবনের সূচনা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরুর যুগেই। ১৯৬৫ সালে প্রচারিত নাটক ‘রক্ত দিয়ে লেখা’ ছিল তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ। পরবর্তীতে তিনি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়সহ একাধিক নাট্যদলে কাজ করেন। মঞ্চে ‘দুই বিয়ে’, ‘চাকা’, ‘পুতুল খেলা’ ইত্যাদিতে তাঁর অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়।

চলচ্চিত্রজগতে অভিষেক ও জীবন থেকে নেওয়া

রওশন জামিলের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ১৯৬৭ সালে ‘আলীবাবা চল্লিশ চোর’ সিনেমার মাধ্যমে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ (১৯৭০)-তে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে। এখানে তিনি এক অভিনয় করেন—যিনি স্বৈরাচারী শাশুড়ি হিসেবে দেশের বিরাজমান স্বৈরাচারের প্রতীক হিসেবে অভিনয় করেন। তার অভিনয় বিশেষ করে শারীরিক অভিব্যক্তি দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলেন একজন স্বৈরচারের মুর্তিকে।

এই ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। শব্দ কম, অভিব্যক্তি বেশি—এমন সংযত অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চরিত্রের মধ্যে জীবন সঞ্চার করেন। বিশেষ করে সিনেমার একটি দৃশ্যে তিনি যখন নিঃশব্দ প্রতিবাদ জানান, সেখানে তাঁর চোখের ভাষা, মুখাবয়ব ও শরীরীভাষার নিপুণ ব্যবহারে দৃশ্যটি হয়ে ওঠে এক আবেগঘন প্রতীকী মুহূর্ত।

অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য

রওশন জামিল সংলাপনির্ভর অভিনয়ের বাইরে গিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, অভিব্যক্তি ও শরীরী ভাষার মধ্য দিয়ে চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে বিশিষ্ট করে তোলে অন্য অনেক অভিনেত্রীর থেকে। তাঁর প্রতিটি চরিত্র ছিল বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি— মাটির কাছাকাছি, যন্ত্রণার ভেতরে থাকা, কিন্তু প্রতিবাদী ও আত্মমর্যাদায় দৃঢ়।

কিংবদন্তী অভিনেত্রী রওশন জামিলের জীবন ও কর্ম

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

  • ১৯৭৬ সালে, ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সহ অভিনেত্রী বিভাগে) লাভ করেন।
  • ১৯৯৫ সালে, তিনি একুশে পদক লাভ করেন নৃত্যকলা বিভাগে।
  • আরও বহুবার পেয়েছেন তারকালোক, ফিল্ম সাংবাদিক সমিতির পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা।

জীবনাবসান ও উত্তরাধিকার

১৪ মে ২০০২, ঢাকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রওশন জামিল। তাঁর স্বামী গওহর জামিল মারা যান ১৯৮০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, একটি সড়ক দুর্ঘটনায়। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি একক প্রচেষ্টায় জাগো আর্ট সেন্টার পরিচালনা করেন এবং সংস্কৃতি জগতে নিজের অবদান রেখে যান নীরবে, কিন্তু গভীরভাবে।

নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণা

রওশন জামিল আজও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য এক অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ শিখিয়ে দেয়—শিল্পচর্চা মানেই আত্মনিবেদন, ধৈর্য এবং সততার বহিঃপ্রকাশ। কথাবার্তার বাহুল্য নয়, বরং সংযমিত অভিব্যক্তিই একজন শিল্পীর প্রকৃত ভাষা হতে পারে—রওশন জামিলের কাজ থেকে এই শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে।

দীপ্ত তারকা

রওশন জামিল ছিলেন নিঃশব্দ এক বিপ্লবী, যিনি কখনও স্লোগান দেননি, কিন্তু অভিনয় ও নৃত্যের মাধ্যমে তিনি সমাজ, নারীজীবন ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। তাঁর প্রস্থানে বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্রজগতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও পূরণ হয়নি। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন — বাংলা সংস্কৃতির নীরব কিন্তু দীপ্ত এক তারকা।

জনপ্রিয় সংবাদ

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহযোগিতায় নতুন দিগন্ত

রওশন জামিল — চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও নৃত্যজগতের আলোকবর্তিকা

১০:৪৫:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

শিল্পের সেবায় এক জীবন

বাংলা নাটক, চলচ্চিত্র ও নৃত্যকলার ইতিহাসে কিছু নাম সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠে কালজয়ী। তেমনি একজন শিল্পী ছিলেন রওশন জামিল। নৃত্যশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন অসাধারণ অভিনেত্রী ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে। তাঁর প্রজ্ঞাময় উপস্থিতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও আবেগের মূর্ত প্রতীক।

জন্ম ও শৈশব: সাংস্কৃতিক পথের সূচনা

রওশন জামিল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ৮ মে, ঢাকা শহরের রোকানপুরে। তাঁর পিতা ছিলেন আবদুল করিম। শৈশব থেকেই তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি নারীশিক্ষা ও নৃত্যচর্চার পথে এগিয়ে যান দৃঢ়তার সঙ্গে। স্কুলজীবন কাটে ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল ও পরে ইডেন মহিলা কলেজে।

গওহর জামিলের সঙ্গে জীবন ও শিল্পের জুটি

নৃত্যশিক্ষার পথেই তাঁর পরিচয় হয় খ্যাতিমান নৃত্যগুরু গণেশ নাথের সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গওহর জামিল নাম নেন। তাঁরা ১৯৫২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৯ সালে দুজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের প্রথম নৃত্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘জাগো আর্ট সেন্টার’—যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর।

টেলিভিশন ও নাট্যজগতে পদচারণা

রওশন জামিলের নাট্য জীবনের সূচনা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরুর যুগেই। ১৯৬৫ সালে প্রচারিত নাটক ‘রক্ত দিয়ে লেখা’ ছিল তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ। পরবর্তীতে তিনি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়সহ একাধিক নাট্যদলে কাজ করেন। মঞ্চে ‘দুই বিয়ে’, ‘চাকা’, ‘পুতুল খেলা’ ইত্যাদিতে তাঁর অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়।

চলচ্চিত্রজগতে অভিষেক ও জীবন থেকে নেওয়া

রওশন জামিলের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ১৯৬৭ সালে ‘আলীবাবা চল্লিশ চোর’ সিনেমার মাধ্যমে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ (১৯৭০)-তে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে। এখানে তিনি এক অভিনয় করেন—যিনি স্বৈরাচারী শাশুড়ি হিসেবে দেশের বিরাজমান স্বৈরাচারের প্রতীক হিসেবে অভিনয় করেন। তার অভিনয় বিশেষ করে শারীরিক অভিব্যক্তি দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলেন একজন স্বৈরচারের মুর্তিকে।

এই ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। শব্দ কম, অভিব্যক্তি বেশি—এমন সংযত অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চরিত্রের মধ্যে জীবন সঞ্চার করেন। বিশেষ করে সিনেমার একটি দৃশ্যে তিনি যখন নিঃশব্দ প্রতিবাদ জানান, সেখানে তাঁর চোখের ভাষা, মুখাবয়ব ও শরীরীভাষার নিপুণ ব্যবহারে দৃশ্যটি হয়ে ওঠে এক আবেগঘন প্রতীকী মুহূর্ত।

অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য

রওশন জামিল সংলাপনির্ভর অভিনয়ের বাইরে গিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, অভিব্যক্তি ও শরীরী ভাষার মধ্য দিয়ে চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে বিশিষ্ট করে তোলে অন্য অনেক অভিনেত্রীর থেকে। তাঁর প্রতিটি চরিত্র ছিল বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি— মাটির কাছাকাছি, যন্ত্রণার ভেতরে থাকা, কিন্তু প্রতিবাদী ও আত্মমর্যাদায় দৃঢ়।

কিংবদন্তী অভিনেত্রী রওশন জামিলের জীবন ও কর্ম

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

  • ১৯৭৬ সালে, ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সহ অভিনেত্রী বিভাগে) লাভ করেন।
  • ১৯৯৫ সালে, তিনি একুশে পদক লাভ করেন নৃত্যকলা বিভাগে।
  • আরও বহুবার পেয়েছেন তারকালোক, ফিল্ম সাংবাদিক সমিতির পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা।

জীবনাবসান ও উত্তরাধিকার

১৪ মে ২০০২, ঢাকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রওশন জামিল। তাঁর স্বামী গওহর জামিল মারা যান ১৯৮০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, একটি সড়ক দুর্ঘটনায়। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি একক প্রচেষ্টায় জাগো আর্ট সেন্টার পরিচালনা করেন এবং সংস্কৃতি জগতে নিজের অবদান রেখে যান নীরবে, কিন্তু গভীরভাবে।

নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণা

রওশন জামিল আজও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য এক অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ শিখিয়ে দেয়—শিল্পচর্চা মানেই আত্মনিবেদন, ধৈর্য এবং সততার বহিঃপ্রকাশ। কথাবার্তার বাহুল্য নয়, বরং সংযমিত অভিব্যক্তিই একজন শিল্পীর প্রকৃত ভাষা হতে পারে—রওশন জামিলের কাজ থেকে এই শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে।

দীপ্ত তারকা

রওশন জামিল ছিলেন নিঃশব্দ এক বিপ্লবী, যিনি কখনও স্লোগান দেননি, কিন্তু অভিনয় ও নৃত্যের মাধ্যমে তিনি সমাজ, নারীজীবন ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। তাঁর প্রস্থানে বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্রজগতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও পূরণ হয়নি। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন — বাংলা সংস্কৃতির নীরব কিন্তু দীপ্ত এক তারকা।