মিষ্টির দেশ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মিষ্টি একটি অপরিহার্য উপাদান। জন্মদিন হোক কিংবা বিয়ে, ঈদ হোক বা পূজা—মিষ্টির উপস্থিতি যেন এক বাধ্যতামূলক ঐতিহ্য। এই দেশে প্রতিটি অঞ্চলই তাদের নিজস্ব স্বাক্ষর মিষ্টান্ন সৃষ্টি করেছে, যেগুলো শুধু স্বাদের জন্যই নয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বেও অনন্য। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বাক্ষর মিষ্টির ইতিহাস, প্রক্রিয়া ও জনপ্রিয়তা নিয়ে তুলে ধরা হলো।
রসগোল্লা – ফরিদপুর ও ময়মনসিংহের গর্ব
যদিও রসগোল্লাকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য বলা হয়, বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা বিপুল। বিশেষ করে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের রসগোল্লা সুস্বাদু ও নরম। ছানার নিখুঁত প্রস্তুতি এবং চিনির পাতলা শিরায় মিশে যে রসগোল্লা তৈরি হয়, তা মুখে দিলে গলে যায়। স্থানীয় মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারীরা যুগ যুগ ধরে এই মিষ্টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন।
সন্দেশ – নবাবগঞ্জ ও বরিশালের উপহার
সন্দেশ মূলত ছানা ও চিনি দিয়ে তৈরি এক অতি সূক্ষ্ম মিষ্টি। নবাবগঞ্জ ও বরিশালে তৈরি বিভিন্ন রকমের সন্দেশ, যেমন নারকেল সন্দেশ, পেস্তা সন্দেশ বা কাঁচা দুধ সন্দেশ অনেকের পছন্দ। সাধারণত এটি ঘি দিয়ে হালকা ভেজে বা শুকনো অবস্থায় পরিবেশন করা হয়। অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে এটি অভিজাত পছন্দ।
চমচম – টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির প্রতীক
টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়ি এলাকার চমচম আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। লালচে বাদামি রঙের এই মিষ্টি খেতে মোলায়েম ও সুগন্ধি। কেওড়া জল ও ঘন দুধের ব্যবহার এটিকে অন্যান্য চমচম থেকে আলাদা করে। বহু প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এটি উপহার হিসেবে বিদেশে নিয়ে যান।
খিরসা – নওগাঁ ও নাটোর অঞ্চলের ঐতিহ্য
খিরসা বা খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি ক্ষীরজাতীয় মিষ্টান্নটি মূলত উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ, নাটোর ও সিরাজগঞ্জে জনপ্রিয়। শীতকালে গরম গরম খিরসা খাওয়ার আলাদা আনন্দ আছে। এটি মূলত চাল, দুধ, খেজুর গুড় এবং ঘন দুধ দিয়ে তৈরি হয়। এই খাবারটি পল্লী জীবন ও উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মণ্ডা – মেহেরপুর ও রাজশাহীর স্বাদ
মেহেরপুর ও রাজশাহীর বিখ্যাত ‘মণ্ডা’ হলো একটি ঘন দুধ দিয়ে তৈরি শক্ত মিষ্টান্ন। এটি বানাতে সময় লাগে বহু ঘণ্টা। ছানার পরিবর্তে সরাসরি ঘন করে ফেলা দুধ দিয়ে তৈরি এই মিষ্টি নানা উৎসব ও পূজায় ব্যবহৃত হয়। অনেকে এটিকে ‘ভিন্ন স্বাদের সন্দেশ’ বলে অভিহিত করেন।
চিতই পিঠা ও নারিকেল-গুড় পায়েস – গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ
যদিও এটি মূলত পিঠা, তবে বাংলার গ্রামীণ উৎসবের অনন্য মিষ্টি হিসেবে চিতই পিঠা ও নারিকেল-গুড়ের পায়েসের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। শীতকালে এই পিঠা-গুড়ের পায়েস গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে তৈরি হয়। এটি কেবল একটি খাবার নয়, বরং আবেগ আর ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ।
নকশিকাঁথা সন্দেশ – ঢাকার আধুনিক উদ্ভাবন
ঢাকার কিছু আধুনিক মিষ্টির দোকান ‘নকশিকাঁথা সন্দেশ’ নামে নতুন ধারার মিষ্টি তৈরি করছে। এটি মূলত সাধারণ সন্দেশের ওপর নানা শিল্পসম্মত নকশা ও রঙ দিয়ে সাজানো হয়। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মের মিষ্টান্নভোক্তাদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস।
ঐতিহ্যের স্বাদে আধুনিকতার ছোঁয়া
বাংলাদেশের মিষ্টির জগৎ শুধু স্বাদের দিক থেকেই নয়, বরং প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ যখন আধুনিক বেকারির আধিপত্য চলছে, তখনো দেশজ এই মিষ্টিগুলো তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখেছে। এগুলো সংরক্ষণ করা শুধু খাদ্যসংস্কৃতির জন্যই নয়, বরং আমাদের সামগ্রিক জাতীয় পরিচয়ের জন্যও জরুরি।