যুক্তরাষ্ট্র-ইন্দোনেশিয়া শুল্ক চুক্তির মূল বিষয়বস্তু
জাকার্তা ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তিতে সম্মত হয়েছে, যার অধীনে ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত প্রায় সব শুল্ক ও অশুল্ক বাধা তুলে দেবে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও ইন্দোনেশিয়ার ওপর হুমকিস্বরূপ ৩২ শতাংশ “পারস্পরিক শুল্ক” কমিয়ে ১৯ শতাংশে আনবে। এই পদক্ষেপ উভয় দেশের বাজারে প্রবেশাধিকারে বিস্তৃত সুযোগ তৈরি করবে।
হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের ৯৯ শতাংশই তুলে দেবে। এর মধ্যে গরুর মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও রাসায়নিক পণ্য অন্তর্ভুক্ত।
বাণিজ্য ঘাটতি ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিশ্রুতি
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭.৯ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি মোকাবিলায় ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে ৩.২ বিলিয়ন ডলারের বিমানের অর্ডার, ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য ও ১৫ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি খাতে চুক্তি করেছে।
ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোর ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
ইন্দোনেশিয়া তার মোট টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানির ৬১ শতাংশ, আসবাব রপ্তানির ৫৯ শতাংশ এবং জুতা রপ্তানির ৩৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। তাই ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে দেশটির রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতো।
আসিয়ান অঞ্চলে চুক্তির প্রভাব ও প্রতিযোগিতা
ইন্দোনেশিয়া এশিয়ান সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কচুক্তিতে পৌঁছেছে। এর আগে ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ এবং ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ হারে শুল্ক নির্ধারণে সম্মত হয়েছে।
অশুল্ক বাধা ও স্থানীয় কনটেন্ট নীতির অবসান
চুক্তির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য স্থানীয় কনটেন্টের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হবে। এর ফলে যেমন Apple-এর iPhone 17 এর মতো পণ্যের বিপণনে সুবিধা হবে, তেমনি মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য ইন্দোনেশিয়ায় নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা
ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র ফিত্রা ফাইসাল হাসতিয়াদি বলেছেন, এই চুক্তি একটি “উইন-উইন” পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এটি জাতীয় জিডিপিতে ০.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, ০.৬ শতাংশ ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রায় ১৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।
শ্রমিক অধিকার ও বিতর্ক
যদিও চুক্তিতে শ্রমিকদের সংগঠন ও যৌথ দরকষাকষির অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রী এয়ারলাঙ্গা হার্তার্তো নিশ্চিত করেছেন, এ জন্য শ্রম আইন পরিবর্তন করা হবে না।
প্রযুক্তি স্থানান্তর ও স্থানীয় সক্ষমতা গড়ে তোলা
ইন্দোনেশিয়ান এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিন্তা ডব্লিউ কামদানি সতর্ক করে বলেন, স্থানীয় কনটেন্ট শর্ত শিথিল করার পাশাপাশি প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য, কৃষিপণ্য ও মেডিকেল যন্ত্রপাতির বাজার উন্মুক্তকরণ
ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য, মাংস, দুগ্ধ ও হাঁস-মুরগির আমদানির লাইসেন্সিং বাধা তুলে নেবে। এছাড়া FDA অনুমোদিত মেডিকেল ডিভাইস ও ওষুধ, এবং গাড়ির নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংক্রান্ত মানদণ্ডকেও স্বীকৃতি দেবে।
ডিজিটাল বাণিজ্য ও পরিবেশবিষয়ক অঙ্গীকার
চুক্তিতে ডিজিটাল পণ্যের ওপর শুল্ক স্থগিত রাখা, সীমান্ত পেরিয়ে তথ্য প্রবাহের বাধা দূর করা এবং WTO-তে ডিজিটাল শুল্কের স্থায়ী স্থগিতাদেশ সমর্থনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। একই সঙ্গে শ্রম অধিকার, বন সংরক্ষণ এবং বিশ্বব্যাপী ইস্পাত উৎপাদনের অতিরিক্ততা নিয়ন্ত্রণে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ: ব্রিকস ও অতিরিক্ত শুল্কের হুমকি
বিশ্লেষক দান্দি রাফিত্রান্দি সতর্ক করে বলেছেন, ব্রিকস সদস্য হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে পারে। তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়াকে ব্রিকসের ভেতরে নিজেদের স্বার্থে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সমাপ্ত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষা
এই ঐতিহাসিক চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।