গঙ্গাচড়ায় হিন্দুপল্লিতে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেটা নতুন কিছু নয়। নিয়মিত বিরতিতে দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটে। বড় একটি ক্ষত তৈরি হওয়ার পর সাময়িক মলম লাগিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক বলে দেওয়ার একটা সরকারি রীতি গড়ে উঠেছে। গঙ্গাচড়ার এক ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘সরকারের লোকজন আজ ক্যা আসি বাড়িঘর ভালো করি দেয় চোল। দলবল নিয়া আসি হামার যে গরু ছাগল হাঁস মুরগি টাকা পয়সা সোনাদানা লুট করি নিয়া গেলই, তার কী হইবে? খাবার জন্য পাঁচ–দশ কেজি করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চাউল দিছে। এই চাউল দিয়াই বা কী হইব? এই ১০ কেজি চাউল না হয় ১০ দিন খামো, এর পরে…?’—২৯ জুলাই, মঙ্গলবার সকালে ভাঙা রান্নার চুলা মেরামতের সময় আক্ষেপ করে এসব কথা বলছিলেন রংপুরের গঙ্গাচড়া আলদাতপুর ছয়আনি হিন্দুপল্লির কণিকা রানী (৪৮)। তিনি আরও জানান, তাঁর বিবাহিত মেয়ের ঘরে রেখে যাওয়া ১ লাখ টাকা এবং রাজমিস্ত্রি ছেলের জমানো ২০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে গেছে।
গত শনিবার ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি ইউনিয়নে এক কিশোরকে আটক করে পুলিশ। অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করেই একদল মানুষ উত্তেজিত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে ভুল করে অন্যজনের বাড়ি আক্রমণ করে, পরে সেই ভুল ‘সংশোধন’ করতে গিয়ে আবার পরিকল্পিত আক্রমণ চালায় হিন্দুপল্লিতে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সম্পদ লুট, সহাবস্থানের বুনন ছিঁড়ে ফেলা—সবকিছু ঘটে পুলিশের সামনেই। এক পুলিশ সদস্য আহত হলেও অনেকে এখনো বিশ্বাস করে না যে পুলিশ তাদের পক্ষে আছে; কারণ ঘটনার দিন থেকেই তারা দেখেছে—রাষ্ট্র থেকেও বড় হয় উন্মত্ততা, সংখ্যাগরিষ্ঠের দম্ভ আর রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।
ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১৮টি পরিবার। আরও প্রায় ৫০টি পরিবার আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর ছেড়েছে। কেউ কেউ ঘরের আসবাব, গবাদিপশু, চাল–ডাল, মূল্যবান সামগ্রী নিজ হাতে বের করে নিচ্ছে—যেন শত্রু সেনাবাহিনী আসার আগে নিজেই ঘর খালি করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন হয়েছে, কিন্তু যাদের ঘর ভাঙা হলো, যাদের চোখের সামনে জীবনের সম্বল পুড়ে গেল, তাদের কাছে এই নিরাপত্তা কেবল বিলম্বিত ট্র্যাজেডি।
রবীন্দ্রনাথ রায় নামে আরেক ভুক্তভোগী বললেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন এসে আমাদের মামলা করতে বলতেছে, কিন্তু এখন যদি মামলা করি, দোষী–নির্দোষী সবাই ফাঁসবে। তখন এই মামলা দিয়ে সবাই ব্যবসা করবে।’ তাঁর কথায় ভেসে আসে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর আশাভঙ্গের সুর; ন্যায্য বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করে।
আটক কিশোরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, তাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। অথচ ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, প্রাণনাশের হুমকি—যাদের সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, তাদের জন্য কোনো ‘আইন’ সক্রিয় নয়। এই নীরবতা, এই দায় এড়িয়ে যাওয়া, ন্যায়ের শীতলতা—এসবই নতুন সহিংসতার পথ খুলে দেয়। কারণ অপরাধীরা জানে—তাদের কোনো পরিণতি নেই; বরং নীরবতার ছায়ায় লুকিয়ে আছে পরোক্ষ বৈধতা।
গঙ্গাচড়ার ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়—এই দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অবস্থান এখনো টালমাটাল। তাদের ওপর হামলার জন্য একটি গুজবই যথেষ্ট, একটি ফেসবুক পোস্টই যথেষ্ট, এমনকি শুধু সন্দেহই যথেষ্ট—ঘরবাড়ি ভাঙতে, জীবন তছনছ করতে, ভিটেমাটি থেকে অস্তিত্ব মুছে দিতে। মামলা করতে তারা ভয় পায়, কারণ জানে—মামলা তাদের নতুন বিপদে ফেলবে। ভিটা থাকবে না, জীবিকা থাকবে না, সামাজিক অবস্থান হারাবে। রাষ্ট্রের মুখ নীরব, প্রশাসনের মুখ গম্ভীর; রাজনীতি পিঠে হাত রাখলেও চোখ রাখে সামনের নির্বাচনের হিসাবে। ফলে কণিকা রানী, রবীন্দ্রনাথ রায়সহ অসংখ্য ভুক্তভোগী বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন—তারা আর নিরাপদ নন। তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে কেবল একটি সংখ্যা, একটি ফাইল, একটি অনুলিপি।
এই বাস্তবতা আমরা কীভাবে মেনে নিই? কবে আমাদের বিবেক জাগবে? আমরা কি বারবার এমন ঘটনার পর শুধু শোকগাথাই লিখব, নাকি এবার জিজ্ঞাসা করব—রাষ্ট্র কি সংখ্যালঘুরও রাষ্ট্র নয়? সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ কি কেবল মুসলমানদের জন্য? সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য? গঙ্গাচড়া আমাদের সামনে একটি আয়না ধরে রেখেছে। সে আয়নায় যদি নিজের মুখ দেখতে না পাই, তবে বুঝতে হবে—আমাদের মুখ আর মানুষের নেই; হয়ে গেছে দলীয়, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এক অমানুষিক মুখাবয়ব। এখনো যদি না জাগি, না বলি, না দাঁড়াই—আগামীকাল আগুন লাগতে পারে আমাদের ঘরেও। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ব্যবধান তখন কেবল সময়ের ব্যাপার। একটি ঘটনারও যদি বিচার না হয়, একজন অপরাধীরও যথাযথ শাস্তি না হয়, তবে এ ধরনের অপরাধ কীভাবে রোধ হবে? আমরা আশা করি—ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার হুজুগের বিপক্ষে কঠোর মনোভাব না দেখালে অপরাধীরা আস্কারা পাবে।
পুনশ্চ: লেখাটি শেষ করার পর একটি খবর নজরে এলো। রংপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার বিচার দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন, তাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতির বাংলাদেশ, ইনসাফের বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’ ২৯ জুলাই টাঙ্গাইলে এনসিপির জুলাই পদযাত্রা উপলক্ষে এক সমাবেশে তিনি আরও বলেন, ‘রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদের নবীজিকে কেউ কটূক্তি করলে তার বিচার চাই, তবে তা আইনের আওতায় হতে হবে। আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। কোনো সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত হানাকে আমাদের ধর্ম অনুমোদন করে না। পিতার অপরাধে পুত্র কিংবা পুত্রের অপরাধে পিতাকে দায়ী করা যাবে না। নবীজি সব সময় অন্য ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। সুতরাং যারা এ ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য ধর্মীয় নয়; তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও লুটপাট।’
নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে দ্বিমত করার সুযোগ কম। এখন দেখার বিষয়, গঙ্গাচড়ার অপরাধীদের বিচারে সরকার শেষ পর্যন্ত কী করে, আর এনসিপি এ নিয়েও কতটা দৃঢ় অবস্থান নেয়। গঙ্গাচড়ার আয়নায় আমরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ দেখতে চাই—ইনসাফ ও সত্যিকারের সম্প্রীতির বাংলাদেশ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতি