পানির অপব্যবহার রোধে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগের তাগিদ
ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট ও ভবিষ্যতে নিরাপদ পানির ঘাটতি মোকাবেলায় পানি অপব্যবহার বন্ধে ব্যক্তি পর্যায় থেকে সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, পানির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কম পানির চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহ এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি।
গোলটেবিল বৈঠক: সংকট নিরসনে করণীয় বিষয়ে বিশদ আলোচনা
১৯ মে ২০২৫, ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এএলআরডি ও বেলা’র যৌথ আয়োজনে এবং পানি অধিকার ফোরামের সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয় ‘ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট: কৃষি ও পরিবেশের ওপর প্রভাব মোকাবেলায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। আলোচনায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বরেন্দ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে
মূল প্রবন্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. চৌধুরী মো. সারোয়ার জাহান বলেন, বরেন্দ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে পানির সংকট মারাত্মক আকার নিচ্ছে। অতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো মৌসুমে পানি উত্তোলনের কারণে ৭-৮ মিটার পর্যন্ত স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ফলে অনেক নলকূপ শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলীয় ৫৩% এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে কৃষি উৎপাদনে সমস্যা তৈরি হয়েছে।
তিনি পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি যেমন ড্রিপ সেচ, অডউ পদ্ধতি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও খাল-পুকুর পুনঃখননের পরামর্শ দেন এবং পানি আইন ২০১৩ ও বিধিমালা ২০১৮ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।
ঢাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি কমে যাওয়ায় নদীর ওপর নির্ভরতা
রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ঢাকা ওয়াসা ৭১% ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করলেও বর্তমানে মেঘনা নদী থেকে পানি আনতে হচ্ছে। ডিজেল চালিত পাম্পের জায়গায় বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প ব্যবহারের ফলে খরচ কমলেও নজরদারির অভাবে পানি অপচয় বাড়ছে।
নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের দাবি
এএলআরডি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি বলেন, গ্রামের নারীদের ৭২% কৃষিতে যুক্ত এবং তারা টেকসই চাষে অবদান রাখছেন। তাই পানি নীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
পানি সুশাসনে ‘৫ পি’ কাঠামোর প্রস্তাব
ইনসিডিন বাংলাদেশের এ কে এম মাসুদ আলী বলেন, পানি সুশাসনে প্রাধান্য, প্রক্রিয়া, প্রযুক্তি, প্রতিষ্ঠান ও প্রয়োগ – এই পাঁচটি ‘প’ মেনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে নারী, কৃষক, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বোরো চাষ সীমিত করার প্রস্তাব
বুয়েটের অধ্যাপক ড. শাহাজাহান মন্ডল বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় বোরো ধানের চাষ সীমিত করে খাল পুনঃখননের উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পানির টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকদের উৎসাহ দিতে শস্য বাছাইয়ের আহ্বান
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মীর আব্দুস সাহিদ জানান, দেশে বছরে ৩২ বিলিয়ন ঘনমিটার ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন হয়। তিনি কম পানি প্রয়োজন এমন ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়ার তাগিদ দেন।
সংকট ব্যবস্থাপনার ঘাটতি: ধানের জন্য দক্ষ পরিকল্পনার আহ্বান
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কামরুজ্জামান বলেন, পানির সংকট মূলত ব্যবস্থাপনার অভাবে হচ্ছে। ধান উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
পানি নীতিমালার হালনাগাদ এবং সঠিক মূল্য নির্ধারণে উদ্যোগ
পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার পরিচালক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, বিদ্যমান পানি আইন ও নীতিমালার হালনাগাদ ও পানির যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে সরকার কাজ করছে।
সুপারিশ বাস্তবায়নের আশ্বাস
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মো. তরিকুল আলম বলেন, আলোচনায় উত্থাপিত সুপারিশসমূহ বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সমন্বয়হীনতা: পানির সংকট আরও বাড়াচ্ছে
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পানির সুশাসনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পানি উত্তোলন ও অপরিকল্পিত নগরায়ন পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। নারী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের ওপর এর প্রভাব গভীর।
আইন থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি
বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, দেশে পর্যাপ্ত আইন থাকলেও বাস্তবায়ন দুর্বল। নদী রক্ষা ও আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের মতামত
গোলটেবিলে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া, রংপুর, পাবনা, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধি আফজাল হোসেন, জিয়াউর রহমান, রাজকুমার শাঁও, বিচিত্রা তির্কি, রেবেকা সুলতানা প্রমুখ মতামত দেন।
এই আলোচনায় উঠে আসে—ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট মোকাবেলায় ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি পরিকল্পনায় সমন্বয়, প্রযুক্তির ব্যবহার, নারীর অংশগ্রহণ ও আইন বাস্তবায়নের গুরুত্ব। নদী, জলাধার রক্ষা এবং টেকসই কৃষিপদ্ধতি গ্রহণই হতে পারে ভবিষ্যৎ পানির নিরাপত্তার পথ।