“কখন যে গাঁজা ধরি, নিজেই জানি না… না নিলে শরীর চলে না ভাই”
চোখ লাল, মুখে কষ্টের ছাপ—রাত ৮টা। গাবতলির এক গ্যারেজের পাশে বসে আছে রিকশাচালক জামাল (ছদ্মনাম)। তার সামনে একটি পলিথিন ব্যাগে মোড়ানো গাঁজা, পাশে আধা বোতল মদ। দিনে রিকশা চালান, রাতে নেশায় হারিয়ে যান।
“দিনে রোদে পুড়ি, রাতে যদি একটু নেশা না করি, শরীর ভেঙে পড়ে। খালি গায়ে চালাই, পেট খালি রেখে কি আর চালানো যায়?”
নেশায় আসক্তির চক্র
ঢাকার প্রায় প্রতিটি বড় গ্যারেজ ও রিকশা স্ট্যান্ডেই আছে ২–৫ জন নেশায় আসক্ত চালক। কারও শুরু হয়েছিল কৌতূহল থেকে, কারও বেদনার দিনে ভুলে থাকার চেষ্টা। কেউ কেউ বলছে—নেশা করলে শক্তি বাড়ে, ঘুম কম লাগে, চালানো সহজ হয়।
এক চালক রুবেল (৩২) জানালেন, “সকাল-বিকালে দুই টান মারি, পা ব্যথা কম লাগে। পরে আস্তে আস্তে বেশি লাগতেছে।”
মাদক মানে টাকা নষ্ট, পরিবার থেকে দূরত্ব
রিকশাচালকদের আয় কম, আবার নেশার জন্য যায় ৫০–২০০ টাকা প্রতিদিন। এতে সংসার ভেঙে যাচ্ছে, বাচ্চারা স্কুল ছাড়ছে, অনেকে গ্রামে মুখ দেখাতে পারেন না।
“স্ত্রী দুই বছর আগে চলে গেছে, কয়—‘তুই মানুষ না, নেশাখোর’,” — বলছিলেন চালক মোশাররফ।
সমাজে তাচ্ছিল্য, পুলিশের ভয়
নেশায় আসক্ত রিকশাচালকদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না। পুলিশও সন্দেহ করে, মাঝে মাঝে হয়রানি করে।
“রিকশা থামায়ে কয়, ‘পকেটে গাঁজা আছে নাকি?’ একবার ধরা পড়লে মামলা, কেস, ঘুষ—কাজ সব শেষ,” বলেন লালবাগ এলাকার চালক শাকিল।
স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি
নেশা শুধু টাকাই নয়, শরীর ও মনও শেষ করে দেয়।
- ঘন ঘন বুক ধড়ফড়ানি
- রাতে ঘুম না হওয়া
- সময়মতো খাওয়া না হওয়া
- একাকিত্ব ও হতাশা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি নেশা মানসিক বিকার সৃষ্টি করে—যা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে ভেঙে ফেলে।
সমাধান কী?
নিম্নবিত্ত কর্মজীবীদের জন্য মাদকাসক্তি প্রতিরোধে দরকার লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ:
- মোবাইল হেলথ ক্যাম্প ও কাউন্সেলিং
- গ্যারেজভিত্তিক মাদকবিরোধী প্রচার
- বিকল্প বিনোদন ও শারীরিক প্রশিক্ষণ
- স্বল্প সুদের ঋণ ও সামাজিক সঞ্চয় প্রকল্প
- এনজিও ও সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে ডি-অ্যাডিকশন কেন্দ্র
চালক জামাল বলেন, “একটা লোক আইসা যদি বলে—চলো ছাড়ো, চাকরি শিখাই—আমি রাজি আছি। শুধু কেউ কাছে আসে না।”
হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্পগুলো
রিকশাচালকদের জীবনে নেশা যেন এক নিষিদ্ধ অবলম্বন—না চাইলে ওরা গ্লানি ভুলতে চায়, ব্যথা কমাতে চায়। কিন্তু সেখানেই তারা হারিয়ে ফেলে নিজেদের, পরিবার, ভবিষ্যৎ—সব।