অর্কিডকে বলা চলে ‘ছলনাময়ী উদ্ভিদ’। অর্কিড যে পরগাছা, সেটা আমরা জানি। কিন্তু এই পরগাছাগুলোই পশু—পাখি, কীটপতঙ্গকে ছলনায় ভুলিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করে নিতে কতটা ওস্তাদ, তা ভাবলে অবাক হতে! কি রকম ছলনা! দুই একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন কোন কোন অর্কিডের ফুল এমন ‘ভাব করে’, যেন তাতে মধু আছে। মধুর গন্ধ পাওয়া যায়, ভেতরে তাকালে মধুর মত তরলও নজরে পড়ে। বাস্তবে এক ফোঁটাও মধু নেই তাতে। মৌমাছি অর্কিডের এই ‘মিথ্যে মধুর’ লোভে এসব ফুলে গিয়ে বসে এবং নিজেদের অজান্তেই সেই ফুলের পরাগ মেখে নেয় শরীরে। এভাবেই মৌমাছিকে ছলনায় ভুলিলে নিজের পরাগায়নটা সেরে নেয় অর্কিড। চীন দেশে ডেনড্রোবিয়াম নামে এক রকমের অর্কিড আছে।
এগুলো বাতাসে ঠিক সেই রাসায়নিক ছড়ায়, যে রাসায়নিক পোকা—মাকড় বিপদে পড়লে বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। যেসব প্রাণী মরা কীট—পতঙ্গ খায় তারা এই রাসায়নিকের গন্ধ পেয়ে সহজ ভোজের আশায় চলে যায় সেখানে। ডেনড্রোবিয়াম অর্কিডের গন্ধে পাহাড়ি ইঁদুর চলে আসে। তারা কাঙ্খিত পোকামাকড় না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যায় বটে তবে যাওয়ার আগে গায়ে মেখে নিয়ে যায় সেই অর্কিডের পরাগ। নিজের অজান্তেই ইঁদুর এর পরাগায়ন ঘটায়। বিশ্বে এমন হাজারো জাতের অর্কিড আছে, যেগুলোর ফুল দেখতে স্ত্রী পতঙ্গের মত। কোনোটা স্ত্রী ভোমরা, কোনোটা স্ত্রী প্রজাপতি, স্ত্রী বোলতা বা স্ত্রী মৌমাছির মত। কোনো ফুল আবার স্ত্রী পতঙ্গের গন্ধ ছড়ায়। পুরুষ পতঙ্গ এসে এসব ফুলের কাছে ভিড় করে এবং সেই অর্কিডকে পরাগায়নে সাহায্য করে। কোনো কোনো অর্কিড পচা মাংসের গন্ধ ছড়ায়। পচা মাংসের লোভে মাছি এসে জোটে এর কাছে।
নানা ধরণের অর্কিডের ‘ধোকাবাজির’ এই বিস্ময়কর ক্ষমতা দেখে সাধারণ মানুষের মত তাক লেগে যায় বিজ্ঞানীদেরও।
সিঙ্গাপুরের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কিয়াট ট্যান কৌতুক করে বলেন, ‘অর্কিডগুলো এমন ধোকাবাজ যে, তারা কীট পতঙ্গ, পশু পাখি, এমনকি মানুষকে দিয়েও তাদের যত ‘বাজে কাজ’ করিয়ে নেয়!’ বছর কয়েক আগে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হল বিশ্বের সবচেয় বড় অর্কিড সম্মেলন। এতে যোগ দিতে এসেছিলেন ৫৫টি দেশের এক হাজার প্রতিনিধি। আর এই সম্মেলন উপলক্ষে একটা অর্কিড প্রতিযোগিতাও হয়েছিল সেখানে। বিভিন্ন দেশের তিন লক্ষাধিক মানুষ দেখেছে এই প্রতিযোগিতা। ইতিহাসে এর চেয়ে বড় অর্কিড প্রতিযোগিতা আর হয়নি। বহু ধরণের অর্কিড আনা হয়েছিল এখানে। সেগুলো দেখতে যেমন বিচিত্র, তেমনি তাদের বৈশিষ্ট্যও। প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল চার একর এলাকা জুড়ে। প্রদর্শনীর একদিন আগে দেশ বিদেশ থেকে যখন এখানে অর্কিড আনা হচ্ছিল, তখন একটা অর্কিডের প্যাকেটে লেখা এক সাবধান বাণী দেখে চমকে উঠতে হয়েছে অনেককে। তাতে লেখা ছিল, ‘সাবধান, ৮ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় রাখুন!’
বিশ্বে সপুষ্পক উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্রময় হল অর্কিড। এর ২৫ হাজারেরও বেশি ধরণের অর্কিড ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা বিশ্বে। বৈচিত্র্য যেমন বেশি, উদ্ভিদ হিসাবে সবচেয়ে কঠিনও বটে। কঠিন বলতে এর কান্ড কঠিন, তা নয়। প্রায় সব পরিবেশেই অর্কিড জন্মাতে এবং টিকে থাকতে পারে। একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া আর সব মহাদেশেই অর্কিডের দেখা মেলে। যেসব স্থানে অন্য উদ্ভিদের জন্মানোর কথা কল্পনাও করা যায় না-সে সব জায়গাতেও চমৎকার আস্তানা গাড়তে পারে অর্কিড। এরা মরুভূমিতে যেমন জন্মায় তেমনি পাথরের খাজে বা অন্য কোন গাছের ডালে টিকে থাকতে এদের কোন অসুবিধা হয় না। তবে এদের পরাগায়ন পদ্ধতিটা বড় জটিল। কাছাকাছি গোত্রের দুই অর্কিডের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবে পরাগায়ন ঘটে না। তাই বনে প্রতিটা অর্কিড তার নিজস্ব চরিত্র, ফুলের রঙ দীর্ঘকাল অপরিবর্তিত রাখতে পারে। আজকাল অবশ্য মানুষ নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে আলাদা আলাদা জাতের অর্কিডের মধ্যে পরাগায়ন ঘটিয়ে ফুলে বৈচিত্র্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা ভালো না মন্দ তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বনে, তাদের স্বাভাবিক পরিবেশে এধরণের শংকরায়ন যে অর্কিডের না—পছন্দ, তা ভালোভাবেই বোঝা যায়।
অর্কিডেরর একান্ত জীবন যাপনের দিকে যারা গভীর ভাবে লক্ষ্য রাখেন তারাই বিস্মিত হন তাদের ‘চাতুরি’ দেখে। প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন ৫৬ বছর বয়স্ক সাংবাদিক মাইকেল পোলান। তিনি লিখেছেন, ‘২৫হাজার প্রজাতির অর্কিড ৮কোটি বছর ধরে পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশে নিজেদের সুন্দরভাবে টিকিয়ে রেখেছে। প্রচণ্ড বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও তাদের জন্মাতে, টিকে থাকতে এবং বংশবিস্তার করতে কোন সমস্যা হয়না। এর কারণ হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন অর্কিডের এই ‘ছলনা করার’ অদ্ভুত ক্ষমতাকে। পরাগায়নের জন্য তারা তাদের এই ‘ছলনা’ করার অত্যাশ্চার্য ক্ষমতাকেই কাজে লাগায়। তার মতে, অর্কিডের রূপ আছে। তার এই রূপ দিয়ে সে মানুষকে পর্যন্ত ভুলিয়ে নিজেদের ‘কাজ হাসিল’ করে নিতে জানে।
মাইকেল পোলান ‘অর্কিডের গোপন জীবন’ নামে এক বইতে লিখেছেন, ‘অরফি’ নামে এক ধরণের অর্কিডের সন্ধান করতে আমি আর আলোকচিত্রী ক্রিশ্চিয়ান জেইগলার গিয়েছিলাম ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার কিছু পাহাড়ে। কোন কোন উদ্ভিদবিজ্ঞানী এই অর্কিডকে ‘গণিকা’ বলেও গাল দিয়ে থাকেন। তারা এই অর্কিডের ক্ষেত্রে এই অভব্য শব্দটি ব্যবহার করেন পরাগায়নের কাজে অরফির চাতুরির কারণে।’ মাইকেল পোলান লিখেছেন, ‘পরাগায়নের জন্য মৌমাছিদের ভোলাতে এরা যে কতটা ছলনার আশ্রয় নেয়, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এই অর্কিডের ফুল দেখতে পুরোপুরি স্ত্রী মৌমাছির মত। গন্ধও তাই। পুরুষ মৌমাছিরা সহজে এই ফুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এবং তারপর যেটা ঘটে-সম্ভব হলে নিজেরাই চোখে দেখবেন!’