০৬:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

কতটা পানি লাগে আপনার

দিনে কতটুকু পানি পান করেন আপনি? সোজা উত্তর। বড়জোর তিন থেকে চার লিটার! কিন্তু যদি বলা হয়, প্রতিদিন কম করে হলেও তিন হাজার লিটার পানি খাচ্ছেন আপনি! এমন কথা শুনলে বক্তাকে হয় পাগল মনে করে ধমক লাগাবেন, নয়তো আষাঢ়ে গল্প ভেবে হাসবেন মনে মনে।

আপাতত আষাঢ়ে গল্প মনে হলেও আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (আইএফএডি) যে হিসাব দিচ্ছে, তা শুনলে কথাটাকে হয়তো আর এতটা তাচ্ছিল্য করা যাবে না। হিসাবটা একটু দেখুন! এই সংস্থা বলছে, আমরা যে ভাত খাই তার জন্য প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে খরচ হয় এক হাজার থেকে তিন হাজার লিটার পানি। আমাদের খাবার প্লেটে এক কেজি খাসির মাংসের যোগান দিতে পানি ব্যয় হয় ১৩ হাজার লিটার থেকে ১৫ হাজার লিটার। শুধু একটা আলু উৎপাদনেই লাগে ২৫ লিটার পানি। একটা টমেটোর জন্য লাগে ১৩ লিটার। আপনার মনের মত এক কাপ চা তৈরি হতেই ব্যয় হয়ে যায় ৩৫ লিটার পানি। এক গ্লাস দুধ তৈরি হতে ২০০ লিটার, এক প্যাকেট আলুর সিপসের জন্য ১৮৪ লিটার, একটা হ্যামবার্গারের জন্য প্রায় আড়াই হাজার লিটার পানি দরকার হয়। ‘মাছে ভাতে বাঙালির’ পাতে এক টুকরো মাছের যোগান দিতে কতটা পানি লাগে, সে হিসাব না হয় না—ই করলেন তবে বাকি সব খাবারের কথা ভেবে এবার বলুন, দিনে তিন হাজার লিটার পানি খাওয়ার হিসাবটা কি খুব বেশি কিছু! হয়তো বলবেন, খেলামই না হয় তিন হাজার লিটার পানি। দৈনিক ছয় হাজার লিটার বা বারো হাজার লিটার পানি খেলেই বা ক্ষতি কী! এত বিশাল বিশাল সাগর মহাসাগর আছে কি করতে! আমাদের পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই তো পানি!

এ কথা ঠিক যে, পৃথিবীর ৭৫ ভাগই পানি। কিন্তু সেই পানির প্রায় ৯০ ভাগই তো কৃষি কাজ বা গবাদি পশু পালনে ব্যবহারের উপযোগী নয়! আমরা যে মিঠা পানির ওপর নির্ভরশীল, তার প্রধান উৎস মূলত পর্বত শীর্ষের বরফ গলা পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, পার্বত্য এলাকার বিশাল বিশাল হ্রদ, এসব এলাকা থেকে প্রবাহিত নদ—নদী আর বৃষ্টি। আমরা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছি যে, বিশ্বে তাপমাত্রা বাড়ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি বড় রকমের বিরূপ প্রভাব ফেলবে মিঠা পানির উৎসগুলো ওপর। হিমালয়ের পাদদেশের বিশাল বিশাল হ্রদের পানি স্তর নামতে শুরু করে দিয়েছে। দুই মেরু বাদ দিলে সবচেয়ে বেশি বরফ জমে যে হিমালয়ে, তার বরফও কমছে দ্রুত।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে দজলা আর ফোরাত নদীর মাঝে সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছিল আক্কাদ নামে এক বিশাল নগরী। এখন যেখানে ইরাকের বাগদাদ, তার কিছুটা দক্ষিণে ছিল এই নগরী। প্রাচীন ইমারতের মর্মরফলকে উৎকীর্ণ লিপি স্বাক্ষ্য দেয়, অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল এই নগরী। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর মাত্র এক শতাব্দী পার হতে না হতেই উল্টে গেল সব। বরং বলা ভালো, সমৃদ্ধ এই নগরী যেন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল। কেন এমন হল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কেউ বলেছেন রাষ্ট্রবিপ্লব, কেউ বলেছেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, কেউ বলেছেন যুদ্ধবিগ্রহ। বিজ্ঞানীরা এ বিতর্কে না জড়িয়ে কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে গেলেন সেখানকার প্রাচীন এক শুস্ক হ্রদের তলদেশে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তারা জানালেন, যুদ্ধবিগ্রহের মত কিছু নয়। স্রেফ আবহাওয়ার পরিবর্তন। ওই এলাকার বৃষ্টিপাতের পরিমান হঠাৎকরেই কমে গিয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে খরা। ফসল উৎপাদন যায় বন্ধ হয়ে। দেখা দেয় হানাহানি, এমনকি রাজনৈতিক বিরোধও। আর এই সমস্ত কারণ এক হয়ে দ্রুত ধ্বংস ডেকে আনে এই নগরীর। শুধু আক্কাদ নয়, প্রায় একই সময় মিশর সাম্রাজ্যেরও পতন হয় এই জলহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেই।

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু হ্রদ দক্ষিণ আমেরিকার টিটিকাকা। যেখানে ঘাসের তৈরি নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় সেখানকার বাসিন্দারা। তার আশেপাশে গড়ে উঠেছিল তিউয়ানাচু সভ্যতা। প্রায় একহাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা ১১০০খ্রিস্টাব্দে হঠাৎকরেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মায়া সভ্যতাও যখন তার উৎকর্ষতার শিখরে, সেই ৮০০খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তারও অবসান ঘটে। অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্যি যে, রাজনৈতিক কারণ নয় বরং জলহাওয়ার পরিবর্তনই এ দুটি সভ্যতা ধ্বংসের জন্য দায়ী। জলহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে এমনিভাবে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য বা সভ্যতার অবসানের নজির মাত্র এটি দু’টি নয় বরং ভুরিভুরি। অতীতে মানুষ শুধু তার গৌরবের ইতিহাস, যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসই লিখে রেখেছে। কিন্তু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে যে প্রকৃতি, তার পরিবর্তনের ইতিহাসকে তারা উপেক্ষা করে এসছে চিরকাল। তবে সে সব ইতিহাস প্রকৃতিই সযত্নে লিখে রেখেছে আপন হাতে। যেমন হ্রদের তলদেশে প্রকৃতির লেখা ইতিহাস ‘পাঠ’ করে বিজ্ঞানীরা জেনে গিয়েছেন আক্কাদ আমলে ইরাকের আবহাওয়া পরিবর্তনের অনেক অজানা কথা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতীতে অনেক সময় বিশ্বে তাপমাত্রা কখনো কমেছে কখনো বেড়েছে। তবে সেই হ্রাস বৃদ্ধিটা প্রাকৃতিক। এখন যে কারণে বাড়ছে, সেটা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। অতীতে তাপমাত্রার এই হ্রাস—বৃদ্ধির মধ্যে যে একটা সাম্য ছিল, এখন সেটা আর নেই। তাপমাত্রার উত্থান পতনের লেখচিত্র এখন ঊর্ধ্বমুখি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৈশ্বিক উষ্ণতা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বয়ে আনবে তেমনি রাজনৈতিক অস্থিরতাও বয়ে আনবে দেশে দেশে। ভবিষ্যতে আক্কাদের মত অনেক সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের বিলুপ্তি দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন তারা।

আরো একশ’ বছর পর শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল পাঠ্যবইয়ে হয়তো পড়বে, ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে সুন্দরবন নামে এক বিশাল বন ছিল। সেখানে বাস করত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঘ বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু এখন সেখানে শুধুই পানি।’ আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী তহবিল (ডব্লিইউ ডব্লিউ এফ) জানিয়েই দিয়েছে ৬০ বছরের মধ্যে তলিয়ে যাবে সুন্দরবন। আমরা জানি, গঙ্গা বা পদ্মা দিয়ে শুধু মিঠা পানিই আসত না, সঙ্গে আসত বিপুল পরিমানে পলি। এই গঙ্গা বা পদ্মা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পলি বহনকারী নদীর অন্যতম। এ নদীর পলি আর মিঠা পানি শুধু সুন্দরবনকে তো বাঁচিয়ে রাখতই, পাশাপাশি এর ওপর নির্ভরশীল ছিল এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা, নদ—নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ, চিংড়ির ঘের—সব মিলিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এছাড়া চাষাবাদের জন্য সেচ এবং পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নামছে। বাংলার বহু অঞ্চলে এখন নলকূপে আর পানি ওঠে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কণ্ঠে তাই উদ্বেগ। তাঁরা বলছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা যদি হয়, তবে তা রাজনৈতিক কারণে নয়, হবে পানির জন্য। প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে না পারলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঠেকানোর কোন পথ নেই।

কতটা পানি লাগে আপনার

০৯:৫৫:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

দিনে কতটুকু পানি পান করেন আপনি? সোজা উত্তর। বড়জোর তিন থেকে চার লিটার! কিন্তু যদি বলা হয়, প্রতিদিন কম করে হলেও তিন হাজার লিটার পানি খাচ্ছেন আপনি! এমন কথা শুনলে বক্তাকে হয় পাগল মনে করে ধমক লাগাবেন, নয়তো আষাঢ়ে গল্প ভেবে হাসবেন মনে মনে।

আপাতত আষাঢ়ে গল্প মনে হলেও আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (আইএফএডি) যে হিসাব দিচ্ছে, তা শুনলে কথাটাকে হয়তো আর এতটা তাচ্ছিল্য করা যাবে না। হিসাবটা একটু দেখুন! এই সংস্থা বলছে, আমরা যে ভাত খাই তার জন্য প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে খরচ হয় এক হাজার থেকে তিন হাজার লিটার পানি। আমাদের খাবার প্লেটে এক কেজি খাসির মাংসের যোগান দিতে পানি ব্যয় হয় ১৩ হাজার লিটার থেকে ১৫ হাজার লিটার। শুধু একটা আলু উৎপাদনেই লাগে ২৫ লিটার পানি। একটা টমেটোর জন্য লাগে ১৩ লিটার। আপনার মনের মত এক কাপ চা তৈরি হতেই ব্যয় হয়ে যায় ৩৫ লিটার পানি। এক গ্লাস দুধ তৈরি হতে ২০০ লিটার, এক প্যাকেট আলুর সিপসের জন্য ১৮৪ লিটার, একটা হ্যামবার্গারের জন্য প্রায় আড়াই হাজার লিটার পানি দরকার হয়। ‘মাছে ভাতে বাঙালির’ পাতে এক টুকরো মাছের যোগান দিতে কতটা পানি লাগে, সে হিসাব না হয় না—ই করলেন তবে বাকি সব খাবারের কথা ভেবে এবার বলুন, দিনে তিন হাজার লিটার পানি খাওয়ার হিসাবটা কি খুব বেশি কিছু! হয়তো বলবেন, খেলামই না হয় তিন হাজার লিটার পানি। দৈনিক ছয় হাজার লিটার বা বারো হাজার লিটার পানি খেলেই বা ক্ষতি কী! এত বিশাল বিশাল সাগর মহাসাগর আছে কি করতে! আমাদের পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই তো পানি!

এ কথা ঠিক যে, পৃথিবীর ৭৫ ভাগই পানি। কিন্তু সেই পানির প্রায় ৯০ ভাগই তো কৃষি কাজ বা গবাদি পশু পালনে ব্যবহারের উপযোগী নয়! আমরা যে মিঠা পানির ওপর নির্ভরশীল, তার প্রধান উৎস মূলত পর্বত শীর্ষের বরফ গলা পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, পার্বত্য এলাকার বিশাল বিশাল হ্রদ, এসব এলাকা থেকে প্রবাহিত নদ—নদী আর বৃষ্টি। আমরা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছি যে, বিশ্বে তাপমাত্রা বাড়ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি বড় রকমের বিরূপ প্রভাব ফেলবে মিঠা পানির উৎসগুলো ওপর। হিমালয়ের পাদদেশের বিশাল বিশাল হ্রদের পানি স্তর নামতে শুরু করে দিয়েছে। দুই মেরু বাদ দিলে সবচেয়ে বেশি বরফ জমে যে হিমালয়ে, তার বরফও কমছে দ্রুত।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে দজলা আর ফোরাত নদীর মাঝে সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছিল আক্কাদ নামে এক বিশাল নগরী। এখন যেখানে ইরাকের বাগদাদ, তার কিছুটা দক্ষিণে ছিল এই নগরী। প্রাচীন ইমারতের মর্মরফলকে উৎকীর্ণ লিপি স্বাক্ষ্য দেয়, অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল এই নগরী। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর মাত্র এক শতাব্দী পার হতে না হতেই উল্টে গেল সব। বরং বলা ভালো, সমৃদ্ধ এই নগরী যেন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল। কেন এমন হল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কেউ বলেছেন রাষ্ট্রবিপ্লব, কেউ বলেছেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, কেউ বলেছেন যুদ্ধবিগ্রহ। বিজ্ঞানীরা এ বিতর্কে না জড়িয়ে কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে গেলেন সেখানকার প্রাচীন এক শুস্ক হ্রদের তলদেশে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তারা জানালেন, যুদ্ধবিগ্রহের মত কিছু নয়। স্রেফ আবহাওয়ার পরিবর্তন। ওই এলাকার বৃষ্টিপাতের পরিমান হঠাৎকরেই কমে গিয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে খরা। ফসল উৎপাদন যায় বন্ধ হয়ে। দেখা দেয় হানাহানি, এমনকি রাজনৈতিক বিরোধও। আর এই সমস্ত কারণ এক হয়ে দ্রুত ধ্বংস ডেকে আনে এই নগরীর। শুধু আক্কাদ নয়, প্রায় একই সময় মিশর সাম্রাজ্যেরও পতন হয় এই জলহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেই।

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু হ্রদ দক্ষিণ আমেরিকার টিটিকাকা। যেখানে ঘাসের তৈরি নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় সেখানকার বাসিন্দারা। তার আশেপাশে গড়ে উঠেছিল তিউয়ানাচু সভ্যতা। প্রায় একহাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা ১১০০খ্রিস্টাব্দে হঠাৎকরেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মায়া সভ্যতাও যখন তার উৎকর্ষতার শিখরে, সেই ৮০০খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তারও অবসান ঘটে। অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্যি যে, রাজনৈতিক কারণ নয় বরং জলহাওয়ার পরিবর্তনই এ দুটি সভ্যতা ধ্বংসের জন্য দায়ী। জলহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে এমনিভাবে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য বা সভ্যতার অবসানের নজির মাত্র এটি দু’টি নয় বরং ভুরিভুরি। অতীতে মানুষ শুধু তার গৌরবের ইতিহাস, যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসই লিখে রেখেছে। কিন্তু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে যে প্রকৃতি, তার পরিবর্তনের ইতিহাসকে তারা উপেক্ষা করে এসছে চিরকাল। তবে সে সব ইতিহাস প্রকৃতিই সযত্নে লিখে রেখেছে আপন হাতে। যেমন হ্রদের তলদেশে প্রকৃতির লেখা ইতিহাস ‘পাঠ’ করে বিজ্ঞানীরা জেনে গিয়েছেন আক্কাদ আমলে ইরাকের আবহাওয়া পরিবর্তনের অনেক অজানা কথা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতীতে অনেক সময় বিশ্বে তাপমাত্রা কখনো কমেছে কখনো বেড়েছে। তবে সেই হ্রাস বৃদ্ধিটা প্রাকৃতিক। এখন যে কারণে বাড়ছে, সেটা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। অতীতে তাপমাত্রার এই হ্রাস—বৃদ্ধির মধ্যে যে একটা সাম্য ছিল, এখন সেটা আর নেই। তাপমাত্রার উত্থান পতনের লেখচিত্র এখন ঊর্ধ্বমুখি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৈশ্বিক উষ্ণতা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বয়ে আনবে তেমনি রাজনৈতিক অস্থিরতাও বয়ে আনবে দেশে দেশে। ভবিষ্যতে আক্কাদের মত অনেক সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের বিলুপ্তি দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন তারা।

আরো একশ’ বছর পর শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল পাঠ্যবইয়ে হয়তো পড়বে, ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে সুন্দরবন নামে এক বিশাল বন ছিল। সেখানে বাস করত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঘ বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু এখন সেখানে শুধুই পানি।’ আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী তহবিল (ডব্লিইউ ডব্লিউ এফ) জানিয়েই দিয়েছে ৬০ বছরের মধ্যে তলিয়ে যাবে সুন্দরবন। আমরা জানি, গঙ্গা বা পদ্মা দিয়ে শুধু মিঠা পানিই আসত না, সঙ্গে আসত বিপুল পরিমানে পলি। এই গঙ্গা বা পদ্মা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পলি বহনকারী নদীর অন্যতম। এ নদীর পলি আর মিঠা পানি শুধু সুন্দরবনকে তো বাঁচিয়ে রাখতই, পাশাপাশি এর ওপর নির্ভরশীল ছিল এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা, নদ—নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ, চিংড়ির ঘের—সব মিলিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এছাড়া চাষাবাদের জন্য সেচ এবং পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নামছে। বাংলার বহু অঞ্চলে এখন নলকূপে আর পানি ওঠে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কণ্ঠে তাই উদ্বেগ। তাঁরা বলছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা যদি হয়, তবে তা রাজনৈতিক কারণে নয়, হবে পানির জন্য। প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে না পারলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঠেকানোর কোন পথ নেই।