পুরনো ঢাকার সরু গলিতে সন্ধ্যা নেমেই যখন আগে অন্ধকার নেমে আসত, তখন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা ঢালাই‑লোহার একটি খুঁটি, তার মাথায় কাঁচের খাপ, আর ভেতরে মিটিমিটি জ্বলার অপেক্ষায় থাকা শিখাই ছিল নাগরিক জীবনের ভরসা। আজ ঘন নীল সড়কবাতির ভিড়ে সেই গ্যাস ল্যাম্পপোস্টেরা প্রায় হারিয়েই গেছে, তবু ঠাটারীবাজার‑চকাবাজারের কয়েকটি নিঃশব্দে শহরকে তার অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি
১৮৭৭ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কেরোসিন‑চালিত রাস্তার বাতি বসায়। তখন থেকেই নগরাঞ্চলে রাতের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
এর আগের বছরই ঢাকার সমাজসেবী নবাব আবদুল গনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘গ্যাসলাইট’ চালুর পরিকল্পনা নেন এবং নগরে পাইপলাইনের মতো কাঠামো গড়ে তুলতে অর্থ ব্যয় করেন—যা ঢাকায় আধুনিক আলোকায়নের পথ খুলে দেয়।
বাতি জ্বালানোর রীতি ও ‘বাতিওয়ালা’
দিনের আলোর ক্ষয় মেপে সূর্য ডোবার ঠিক আগে ‘বাতিওয়ালা’ বা ‘কাঠি‑ওয়ালা’ নামে পরিচিত পৌরসভার মজুরেরা কাঁধে কেরোসিনের টিন, লম্বা বাঁশের আগায় জ্বলন্ত সলতে ও সিঁড়ি নিয়ে বের হতেন। প্রতিটি খুঁটির শিকল টেনে কাঁচের ঢাকনা খুলে কেরোসিন ঢেলে সলতে জ্বালিয়ে রাখা হতো; ভোরে আবার এসে বাতি নিভিয়ে পরিষ্কার করা ছিল তাদের দায়িত্ব। এই দৃশ্যই ছিল পুরনো ঢাকার দৈনন্দিন ছন্দের অংশ।
সামাজিক প্রভাব
রাতেও আলোর সুবাদে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেরি পর্যন্ত খোলা থাকত, আড্ডা‑সাংস্কৃতিক আসর বাড়ত, আর শহরের সুরক্ষা ব্যবস্থা নতুন মাত্রা পায়। বিশেষত সদরঘাট থেকে নতুনবাজার পর্যন্ত নৌকা‑ঘাট, চৌরাস্তা ও আদালতপাড়া এলাকায় গ্যাস বাতি পথচারীদের নিশ্চিন্ত চলাচল নিশ্চিত করেছিল।
বিদ্যুৎ যুগ ও গ্যাস বাতির অপসরণ
নবাব খাজা আহসানউল্লাহর অনুদানে ৭ ডিসেম্বর ১৯০১‑এর রাতে যখন ঢাকা প্রথম বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে ওঠে, তখন থেকেই গ্যাস‑কেরোসিন বাতির প্রয়োজন দ্রুত কমতে থাকে।
তবু ১৯৩৫ সালেও শহরে ৮৬৯টি কেরোসিন ল্যাম্প আর ১,০৬৬টি বৈদ্যুতিক বাতি সহাবস্থান করেছিল—প্রমাণ করে যে গ্যাস‑কেরোসিন ব্যাক‑আপ আলোর মূল্য তখনও শেষ হয়নি।
বেঁচে থাকা স্মৃতিস্তম্ভ
ঠাটারীবাজার, বংশাল ও শাখারী বাজারে ছেয়ে থাকা কয়েকটি ঢালাই‑লোহার খুঁটি আজও দাঁড়িয়ে আছে; কাচ ভাঙা, গ্যাস নল নিখোঁজ, তবু শিল্পশৈলীর ছাপ বহন করছে। দোকানদাররা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছেন, কেউ আবার ল্যাম্পপোস্টকে ছোট ফলক বানিয়ে রেখেছেন। স্থানীয় প্রবীণদের কাছে এগুলো শুধু নিস্তেজ ধাতু নয়—শহরের যৌবনের সাক্ষী।
সংরক্ষণ জরুরি কেন
এই লৌহদণ্ড ও তাদের ইতিহাস সংরক্ষণ করলে ঢাকার পর্যটন, নগর ঐতিহ্যচর্চা ও শিশু‑কিশোরদের শেখার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। কুমিল্লা‑ময়মনসিংহ থেকে আসা পর্যটকেরাও পুরনো শহরের হাঁটাপথে একটি ‘গ্যাস ল্যাম্পপোস্ট ট্রেইল’ পেলে ঢাকার অতীতকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাবেন। নগর ভবন চাইলে বেঁচে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোর গায়ে QR কোড বসিয়ে ভার্চুয়াল গল্পসংগ্রহ তৈরি করতে পারে, যেমনটা বিশ্বের বিভিন্ন হেরিটেজ সিটিতে করা হয়।
ঢাকার গ্যাস ল্যাম্পপোস্ট শুধু প্রাচীন আলোকব্যবস্থার নিদর্শন নয়; এগুলো নাগরিক স্মৃতির কষ্টিপাথর। আধুনিক এলইডি বাতির তীব্র আলোয় তাদের অবস্থান হয়তো ক্ষীণ, কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তারা আজও জ্বলছে—মিটিমিটি শিখা হয়ে। যতদিন পুরনো ঢাকার গলিতে সেই ঢালাই‑লোহার স্তম্ভগুলি দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন ঢাকা তার অতীতকে ভুলে যাবে না, বরং ধুলোমাখা স্মৃতির ঝাপসা আলোয় নিজেকে নতুন করে চিনে নেবে।