০৬:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ঘোড়ার টগবগে হইচইয়ে সবজির শহর রাজশাহী

ভূমিকা

তিন দশক আগের রাজশাহী নগরীর ভোর মানেই ছিল ঘোড়ার টগবগে পায়ে ছুট। শহরের পশ্চিম প্রান্তের পবা ও গোদাগাড়ি উপজেলার মাঠঘেরা গ্রামগুলো থেকে ‘জিগ’ নামে পরিচিত সাদামাটা দু‑চাকার ঘোড়াগাড়িতে টুকটাক সবজি ভরে ছুটে আসতেন কৃষকেরা। সেই বেগুন‑কপি‑লাউভরা গাড়িগুলি শাহীবাজারের ফটকে ঢুকতেই পুরো অঞ্চলটা জেগে উঠত। ঘোড়ার লোমে ঘাম, মালিকের মুখে হাসি আর কাঁচা তরিতরকারির সবুজ সুবাস—রাজশাহী তখন এভাবেই দিনের নতুন সূচনা করত।

শহরের ফজরের বাজার

শাহীবাজার এলাকায় ঘোড়াগাড়িগুলির দাঁড়ানোর আলাদা ‘কারগো লাইনে’ ভোর সাড়ে পাঁচটার আগে থেকেই ভিড় লেগে যেত। প্রতি গাড়ি ৮‑১০ মণ পর্যন্ত মেশানো সবজি আনত—গোলগাপ্পার মতো টইটম্বুর মটর, তুলতুলে ফুলকপি, আর লালচে পাকাপাকা টমেটো। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুদি ও পাইকারি দোকানি‑বিক্রেতারা ‘পসরা থেকে পসরা’ দৌড়ে মেপে‑দামাদামি করে মাল তুলতেন। গাড়ির পেছনে বাঁশের মোটা দড়ির চাবুক ঝুলিয়ে রাখতেন ‘কোচওয়ান’—বাজার ঘুরে কোন দোকানি কতটা বকেয়া দিলেন, তার হিসেবটাও সেই রাখতেন খাতায়।

পরিবহনের অর্থনীতি

সে সময় পেট্রোলচালিত পিক‑আপ ভ্যান রাজশাহীতে হাতে গোনা, ভাড়াও তুলনায় বেশি। একটি ঘোড়াগাড়ি কিনতে লাগত প্রায় ১৫‑১৮ হাজার টাকা। ঘোড়াটি যতটা সবল, ভাড়া ততটাই চড়া—এক ফেরা গড়ে ৮০‑১০০ টাকা। দিনে দুই ফেরা করলেই চালকের লাভ থাকত। স্থানীয় ভাবে এসব গাড়িকে বলা হত ‘জিগ’; উত্তরবঙ্গের সড়কে এখনও দু‑একটি জিগ টিকে আছে বলে ব্রিটানিকা উল্লেখ করে ।

ঘোড়া ও কোচওয়ানের বন্ধন

কোচওয়ানরা সাধারণত ঘোড়াটিকে ‘সাথী’ বা ‘মদন’‑এর মতো আদুরে নামে ডাকতেন। ভোরের ঘাস‑খড়ের খোরাক, দুপুরে আখের রস—এসব ঘোড়ার পুষ্টি তালিকায় থাকত। শহরের শিশু‑কিশোররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোড়ার গ্রীবায় হাত বুলিয়ে নিতেই চালক একটু ‘চালু’ হাঁক দিতেন। এ ছিল রুটি‑রুজির পাশাপাশি শহরের অনানুষ্ঠানিক বিনোদন।

বাজারের প্রাণ‑সঞ্চালক

বাজারে ঘোড়াগাড়ির মিছিল ছিল যেন মোবাইল রেফ্রিজারেটর। সবজি অতিরিক্ত গরমে পচত না, রাস্তা কাঁদা হলেও চাকা আটকাত না। শাহীবাজার থেকে শহরের কাঁটাখালী, লক্ষ্মীপুর, উপশহর—সবখানে এমন ‘ডিস্ট্রিবিউশন চেইন’ চলত ঘোড়ার ভরসায়। ব্যবসায়ীরা বলেন, ঘোড়ার গাড়ি ছিল “সবজির শীতল ছাতা”।

পরিবর্তনের হাওয়া

নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে সিএনজি‑চালিত টেম্পো ও পিক‑আপ ভ্যানের দৌড় বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট পাকা হওয়া, কম দামে ইঞ্জিনচালিত যান পাওয়া আর ডিগ্রি কলেজের সামনে ‘টমটম’ (দুই দিক খোলা যাত্রীবাহী ঘোড়াগাড়ি) বন্ধের সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে জিগের দিন ফুরোয়। রাজধানী ঢাকায় ‘টমটম’ এই সময়ে নগর স্মৃতির অংশ হতে থাকে । ২০০৫‑এর পর ঘোড়ায় সবজি আনা দেখাই বিরল। বর্তমানে মাত্র দুই‑একটি ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়—পবা থানার গোরশা হাটে এক বৃদ্ধ আজও সপ্তাহে এক দিন ঘোড়ায় শশা নিয়ে আসেন।

রাজশাহীর ঘোড়াগাড়িভিত্তিক সবজি পরিবহণ কেবলই এক পদ্ধতির গল্প নয়; এটি শহরের সমাজ‑সংস্কৃতির অংশ ছিল। ঘোড়ার ক্ষুরের ছন্দে বাজার জেগে উঠত, কৃষক‑বেপারি‑ক্রেতার নানা রঙে গুলে যেত নগর সকাল। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সেই দৃশ্য এখন শোনা যায় শুধু প্রবীণদের স্মৃতিচারণায়। তবু শহরের গলি মাড়িয়ে গেলে কখনও‑সখনও বাতাসে ভেসে আসে ঘোড়ার ক্ষুরের কাল্পনিক টগবগ শব্দ—মনে করিয়ে দেয় স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সবুজ পরিবহণ দিনপঞ্জির কথা।

ঘোড়ার টগবগে হইচইয়ে সবজির শহর রাজশাহী

০৩:৪৩:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

ভূমিকা

তিন দশক আগের রাজশাহী নগরীর ভোর মানেই ছিল ঘোড়ার টগবগে পায়ে ছুট। শহরের পশ্চিম প্রান্তের পবা ও গোদাগাড়ি উপজেলার মাঠঘেরা গ্রামগুলো থেকে ‘জিগ’ নামে পরিচিত সাদামাটা দু‑চাকার ঘোড়াগাড়িতে টুকটাক সবজি ভরে ছুটে আসতেন কৃষকেরা। সেই বেগুন‑কপি‑লাউভরা গাড়িগুলি শাহীবাজারের ফটকে ঢুকতেই পুরো অঞ্চলটা জেগে উঠত। ঘোড়ার লোমে ঘাম, মালিকের মুখে হাসি আর কাঁচা তরিতরকারির সবুজ সুবাস—রাজশাহী তখন এভাবেই দিনের নতুন সূচনা করত।

শহরের ফজরের বাজার

শাহীবাজার এলাকায় ঘোড়াগাড়িগুলির দাঁড়ানোর আলাদা ‘কারগো লাইনে’ ভোর সাড়ে পাঁচটার আগে থেকেই ভিড় লেগে যেত। প্রতি গাড়ি ৮‑১০ মণ পর্যন্ত মেশানো সবজি আনত—গোলগাপ্পার মতো টইটম্বুর মটর, তুলতুলে ফুলকপি, আর লালচে পাকাপাকা টমেটো। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুদি ও পাইকারি দোকানি‑বিক্রেতারা ‘পসরা থেকে পসরা’ দৌড়ে মেপে‑দামাদামি করে মাল তুলতেন। গাড়ির পেছনে বাঁশের মোটা দড়ির চাবুক ঝুলিয়ে রাখতেন ‘কোচওয়ান’—বাজার ঘুরে কোন দোকানি কতটা বকেয়া দিলেন, তার হিসেবটাও সেই রাখতেন খাতায়।

পরিবহনের অর্থনীতি

সে সময় পেট্রোলচালিত পিক‑আপ ভ্যান রাজশাহীতে হাতে গোনা, ভাড়াও তুলনায় বেশি। একটি ঘোড়াগাড়ি কিনতে লাগত প্রায় ১৫‑১৮ হাজার টাকা। ঘোড়াটি যতটা সবল, ভাড়া ততটাই চড়া—এক ফেরা গড়ে ৮০‑১০০ টাকা। দিনে দুই ফেরা করলেই চালকের লাভ থাকত। স্থানীয় ভাবে এসব গাড়িকে বলা হত ‘জিগ’; উত্তরবঙ্গের সড়কে এখনও দু‑একটি জিগ টিকে আছে বলে ব্রিটানিকা উল্লেখ করে ।

ঘোড়া ও কোচওয়ানের বন্ধন

কোচওয়ানরা সাধারণত ঘোড়াটিকে ‘সাথী’ বা ‘মদন’‑এর মতো আদুরে নামে ডাকতেন। ভোরের ঘাস‑খড়ের খোরাক, দুপুরে আখের রস—এসব ঘোড়ার পুষ্টি তালিকায় থাকত। শহরের শিশু‑কিশোররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোড়ার গ্রীবায় হাত বুলিয়ে নিতেই চালক একটু ‘চালু’ হাঁক দিতেন। এ ছিল রুটি‑রুজির পাশাপাশি শহরের অনানুষ্ঠানিক বিনোদন।

বাজারের প্রাণ‑সঞ্চালক

বাজারে ঘোড়াগাড়ির মিছিল ছিল যেন মোবাইল রেফ্রিজারেটর। সবজি অতিরিক্ত গরমে পচত না, রাস্তা কাঁদা হলেও চাকা আটকাত না। শাহীবাজার থেকে শহরের কাঁটাখালী, লক্ষ্মীপুর, উপশহর—সবখানে এমন ‘ডিস্ট্রিবিউশন চেইন’ চলত ঘোড়ার ভরসায়। ব্যবসায়ীরা বলেন, ঘোড়ার গাড়ি ছিল “সবজির শীতল ছাতা”।

পরিবর্তনের হাওয়া

নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে সিএনজি‑চালিত টেম্পো ও পিক‑আপ ভ্যানের দৌড় বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট পাকা হওয়া, কম দামে ইঞ্জিনচালিত যান পাওয়া আর ডিগ্রি কলেজের সামনে ‘টমটম’ (দুই দিক খোলা যাত্রীবাহী ঘোড়াগাড়ি) বন্ধের সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে জিগের দিন ফুরোয়। রাজধানী ঢাকায় ‘টমটম’ এই সময়ে নগর স্মৃতির অংশ হতে থাকে । ২০০৫‑এর পর ঘোড়ায় সবজি আনা দেখাই বিরল। বর্তমানে মাত্র দুই‑একটি ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়—পবা থানার গোরশা হাটে এক বৃদ্ধ আজও সপ্তাহে এক দিন ঘোড়ায় শশা নিয়ে আসেন।

রাজশাহীর ঘোড়াগাড়িভিত্তিক সবজি পরিবহণ কেবলই এক পদ্ধতির গল্প নয়; এটি শহরের সমাজ‑সংস্কৃতির অংশ ছিল। ঘোড়ার ক্ষুরের ছন্দে বাজার জেগে উঠত, কৃষক‑বেপারি‑ক্রেতার নানা রঙে গুলে যেত নগর সকাল। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সেই দৃশ্য এখন শোনা যায় শুধু প্রবীণদের স্মৃতিচারণায়। তবু শহরের গলি মাড়িয়ে গেলে কখনও‑সখনও বাতাসে ভেসে আসে ঘোড়ার ক্ষুরের কাল্পনিক টগবগ শব্দ—মনে করিয়ে দেয় স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সবুজ পরিবহণ দিনপঞ্জির কথা।