০২:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

শুল্কে বদলে যাওয়া বৈশ্বিক বাণিজ্য

এক নতুন বাণিজ্য প্যারাডাইম
বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্য নিয়ম যেন প্রতিদিনই পাল্টে যাচ্ছে। আলোচিত মার্কিন শুল্ক যুদ্ধের আড়ালে আরও গভীর এক রূপান্তর এগিয়ে চলছে: উদীয়মান অর্থনীতি, পুনর্গঠিত সরবরাহ শৃঙ্খল এবং আঞ্চলিক জোটের উত্থান।

উদীয়মান দক্ষিণের ভরকেন্দ্র সরে যাচ্ছে
জাতিসংঘের আফ্রিকা বিষয়ক অর্থনৈতিক কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫‑এর পর থেকে উন্নত দেশের “উত্তর‑উত্তর” বাণিজ্য প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে, বিপরীতে “দক্ষিণ‑দক্ষিণ” লেনদেন ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে এক‑মেরু তীব্র আধিপত্যের বদলে বহু‑মেরু বাণিজ্য ব্যবস্থা দ্রুত স্পষ্ট হচ্ছে।

চীনের প্রভাব ও বেল্ট অ্যান্ড রোড
চীনের সঙ্গে এখন ১২০টিরও বেশি দেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়। ২০২৪ সালে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। ১০৪ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে বাধা দিলেও, বেল্ট অ্যান্ড রোড আর বহুপাক্ষিক চুক্তি চীনকে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ায় আরও শক্ত অবস্থান দিচ্ছে।

আফ্রিকার সম্ভাবনা
২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ মানুষ আফ্রিকায় বাস করবে। আফ্রিকান মহাদেশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা কেন্দ্রিক (এএফসিএফটিএ) উদ্যোগ তরুণ জনশক্তি আর মধ্যবিত্ত বাজারকে সক্রিয় করছে। এখনো যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেশি হলেও, মূল্য সংযোজন খাতে বিনিয়োগ পেলে আফ্রিকা আগামী ২৫ বছরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রধান ইঞ্জিন হতে পারে।

মধ্যম আয়ের দেশের নতুন কৌশল
ইন্দোনেশিয়া, তুরস্কের মতো দেশ নানা জোটে নিজেদের সামঞ্জস্য করছে। ইন্দোনেশিয়ার মোট বাণিজ্যের এক‑চতুর্থাংশই চীনের সঙ্গে, আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও উদ্বৃত্ত রপ্তানি বজায় রাখছে। গবেষকদের মতে, এসব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলাতে বৃহত্তর জোট (যেমন ইইউ/যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল) গড়ে তুলতে পারে।

শুল্ক যুদ্ধের দীর্ঘ ছায়া
ট্রাম্প প্রশাসনে শুরু হওয়া স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, কৃষিপণ্যের শুল্ক আজও বহাল; অনেকে আরও বাড়তি শুল্কের মুখে পড়ছে। ২০১৮–২০২৩ মেয়াদে চীন ৯টি, ইউরোপ ৮টি নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে, যুক্তরাষ্ট্র কোনোটি নয়। গবেষক অমৃতা সাহা বলেছেন, আয়ের ঘাটতি কমাতে শুল্ক‑রাজস্ব সহায়তা করলেও, দামে বাড়তি চাপ কম আয়ের ভোক্তাদের বেশি কষ্ট দেয়।

সরবরাহ শৃঙ্খলের জটিলতা
সমস্যা আরও বেড়ে যায়, কারণ এক মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা হয়ে একত্র হয়। কোথাও একটি শুল্ক বাড়লেই সারা শৃঙ্খলের উপর এর জেরে পড়ে; তাই প্রতিশোধমূলক শুল্ক প্রায়ই ঘরোয়া রাজনীতির দাবি মেটায়, কিন্তু বৈশ্বিক দক্ষতা নষ্ট করে।

আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটের আকর্ষণ
আসিয়ান, সিপিটিপিপি, আফসিএফটিএ ইত্যাদি অঞ্চলভিত্তিক ব্লকগুলো বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিচ্ছে। সয়াবিনের উদাহরণই ধরা যাক—যুক্তরাষ্ট্র আগে বিশ্বের ৩০ শতাংশ সয়াবিন রপ্তানি করত; শুল্কের পর চীন এখন দক্ষিণ আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে।

দরিদ্র দেশের জন্য ‘এড ফোর ট্রেড’
১৯৯০–২০২৩ মেয়াদে এক‑শতকোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে, আংশিক বৈশ্বিক বাণিজ্যের কল্যাণে। কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধিতে ভোজ্যতেল, বুনিয়াদি বস্ত্রের দাম বাড়লে দরিদ্র পরিবারগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণা বলছে, ‘এড ফোর ট্রেড’‑এ অতিরিক্ত ১ ডলার বিনিয়োগ উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি ৮ ডলার এবং স্বল্প‑আয় দেশের ২০ ডলার পর্যন্ত বাড়াতে পারে।

অনিশ্চিত কিন্তু আন্তঃনির্ভর ভবিষ্যৎ
বিশ্ব বাণিজ্য একক আধিপত্য থেকে ক্রমে জাল‑মতো ছড়ানো কেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছে। যেসব দেশ নতুন সরবরাহ শৃঙ্খল ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় মানিয়ে নিতে পারবে, তারা লাভবান হবে; পুরোনো মডেলে আটকে থাকা দেশগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। গবেষক অমৃতা সাহার ভাষায়, ‘এখন আর শুধু বাণিজ্য নয়—বিশ্বের সংযোগের ধারা সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।’

শুল্কে বদলে যাওয়া বৈশ্বিক বাণিজ্য

১০:০০:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

এক নতুন বাণিজ্য প্যারাডাইম
বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্য নিয়ম যেন প্রতিদিনই পাল্টে যাচ্ছে। আলোচিত মার্কিন শুল্ক যুদ্ধের আড়ালে আরও গভীর এক রূপান্তর এগিয়ে চলছে: উদীয়মান অর্থনীতি, পুনর্গঠিত সরবরাহ শৃঙ্খল এবং আঞ্চলিক জোটের উত্থান।

উদীয়মান দক্ষিণের ভরকেন্দ্র সরে যাচ্ছে
জাতিসংঘের আফ্রিকা বিষয়ক অর্থনৈতিক কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫‑এর পর থেকে উন্নত দেশের “উত্তর‑উত্তর” বাণিজ্য প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে, বিপরীতে “দক্ষিণ‑দক্ষিণ” লেনদেন ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে এক‑মেরু তীব্র আধিপত্যের বদলে বহু‑মেরু বাণিজ্য ব্যবস্থা দ্রুত স্পষ্ট হচ্ছে।

চীনের প্রভাব ও বেল্ট অ্যান্ড রোড
চীনের সঙ্গে এখন ১২০টিরও বেশি দেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়। ২০২৪ সালে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। ১০৪ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে বাধা দিলেও, বেল্ট অ্যান্ড রোড আর বহুপাক্ষিক চুক্তি চীনকে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ায় আরও শক্ত অবস্থান দিচ্ছে।

আফ্রিকার সম্ভাবনা
২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ মানুষ আফ্রিকায় বাস করবে। আফ্রিকান মহাদেশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা কেন্দ্রিক (এএফসিএফটিএ) উদ্যোগ তরুণ জনশক্তি আর মধ্যবিত্ত বাজারকে সক্রিয় করছে। এখনো যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেশি হলেও, মূল্য সংযোজন খাতে বিনিয়োগ পেলে আফ্রিকা আগামী ২৫ বছরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রধান ইঞ্জিন হতে পারে।

মধ্যম আয়ের দেশের নতুন কৌশল
ইন্দোনেশিয়া, তুরস্কের মতো দেশ নানা জোটে নিজেদের সামঞ্জস্য করছে। ইন্দোনেশিয়ার মোট বাণিজ্যের এক‑চতুর্থাংশই চীনের সঙ্গে, আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও উদ্বৃত্ত রপ্তানি বজায় রাখছে। গবেষকদের মতে, এসব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলাতে বৃহত্তর জোট (যেমন ইইউ/যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল) গড়ে তুলতে পারে।

শুল্ক যুদ্ধের দীর্ঘ ছায়া
ট্রাম্প প্রশাসনে শুরু হওয়া স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, কৃষিপণ্যের শুল্ক আজও বহাল; অনেকে আরও বাড়তি শুল্কের মুখে পড়ছে। ২০১৮–২০২৩ মেয়াদে চীন ৯টি, ইউরোপ ৮টি নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে, যুক্তরাষ্ট্র কোনোটি নয়। গবেষক অমৃতা সাহা বলেছেন, আয়ের ঘাটতি কমাতে শুল্ক‑রাজস্ব সহায়তা করলেও, দামে বাড়তি চাপ কম আয়ের ভোক্তাদের বেশি কষ্ট দেয়।

সরবরাহ শৃঙ্খলের জটিলতা
সমস্যা আরও বেড়ে যায়, কারণ এক মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা হয়ে একত্র হয়। কোথাও একটি শুল্ক বাড়লেই সারা শৃঙ্খলের উপর এর জেরে পড়ে; তাই প্রতিশোধমূলক শুল্ক প্রায়ই ঘরোয়া রাজনীতির দাবি মেটায়, কিন্তু বৈশ্বিক দক্ষতা নষ্ট করে।

আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটের আকর্ষণ
আসিয়ান, সিপিটিপিপি, আফসিএফটিএ ইত্যাদি অঞ্চলভিত্তিক ব্লকগুলো বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিচ্ছে। সয়াবিনের উদাহরণই ধরা যাক—যুক্তরাষ্ট্র আগে বিশ্বের ৩০ শতাংশ সয়াবিন রপ্তানি করত; শুল্কের পর চীন এখন দক্ষিণ আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে।

দরিদ্র দেশের জন্য ‘এড ফোর ট্রেড’
১৯৯০–২০২৩ মেয়াদে এক‑শতকোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে, আংশিক বৈশ্বিক বাণিজ্যের কল্যাণে। কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধিতে ভোজ্যতেল, বুনিয়াদি বস্ত্রের দাম বাড়লে দরিদ্র পরিবারগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণা বলছে, ‘এড ফোর ট্রেড’‑এ অতিরিক্ত ১ ডলার বিনিয়োগ উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি ৮ ডলার এবং স্বল্প‑আয় দেশের ২০ ডলার পর্যন্ত বাড়াতে পারে।

অনিশ্চিত কিন্তু আন্তঃনির্ভর ভবিষ্যৎ
বিশ্ব বাণিজ্য একক আধিপত্য থেকে ক্রমে জাল‑মতো ছড়ানো কেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছে। যেসব দেশ নতুন সরবরাহ শৃঙ্খল ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় মানিয়ে নিতে পারবে, তারা লাভবান হবে; পুরোনো মডেলে আটকে থাকা দেশগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। গবেষক অমৃতা সাহার ভাষায়, ‘এখন আর শুধু বাণিজ্য নয়—বিশ্বের সংযোগের ধারা সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।’