বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের একটি অংশ এখন মাদকাসক্তি ও সহিংস ছাত্র‑রাজনীতির দ্বৈত ঝুঁকিতে পড়ছে। পুলিশ ও ডিপার্টমেন্ট অব নারকোটিক্স কন্ট্রোল (ডিএনসি)‑এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে অনুমানিক ৮০ লাখের বেশি মানুষ নিয়মিত মাদক সেবন করে; তাদের সিংহভাগই কিশোর‑তরুণ, অর্থাৎ ১৫‑৩০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ও সদ্য পাস করা যুবক‑যুবতী ।
পরিবারে সংকট
ডিএনসি‑র মাঠপর্যায়ের জরিপ বলছে, পারিবারিক সচেতনতার অভাব (৪৫.৪৬ শতাংশ) ও দীর্ঘমেয়াদি পারিবারিক দ্বন্দ্ব (১৮.১৮ শতাংশ) তরুণদের মাদকাসক্তির বড় কারণ । যখন শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এমন পথে জড়ায়, তখন পরিবারগুলো দু’রকম সংকটে পড়ে—একদিকে নেশার ব্যয় ও আচরণগত সমস্যা, অন্যদিকে সামাজিক সম্মানহানি। বাবা‑মা অনেক সময়ে সন্তানকে চাকরি বা পড়াশোনায় স্থির রাখতে গিয়ে অনবরত দেনা করতে বাধ্য হন, অথচ নেশা‑রাজনীতি‑সহিংসতার চক্রে পড়ে সন্তানেরা ঘরে ফিরতে চায় না।
মাদকাসক্তির প্রেক্ষিতে শিক্ষিত তরুণ
জাতীয় পর্যায়ের পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো বলছে, তাদের নতুন ভর্তিকৃতদের অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজপড়ুয়া । ইয়াবা ও আইসের মতো সিনথেটিক ড্রাগ এখন ক্যাম্পাসের নৈশকালীন আড্ডায় ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ হিসেবে প্রচলিত, যা দ্রুত মানসিক‑শারীরিক অবনতির দিকে ঠেলে দেয়।
নতুন প্রজন্মের রাজনীতি ও সহিংসতা
২০২৪ সালের ছাত্র‑জনতার অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী আন্দোলনগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মাদকাসক্তদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে; অনেক ক্ষেত্রেই তারা ককটেল, আগুন বা ধারালো অস্ত্রের সহিংসতায় জড়িয়েছে । কোটা সংস্কার আন্দোলন, নির্বাচনী বাতিল‑বহাল, কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের দাবিতে হওয়া বিক্ষোভে পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছে—ক্যাম্পাস বারবার বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে ।
মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ
বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রবল প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, বেকারত্বের ভয়, ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মিশ্রণ তরুণদের হতাশ করে। সেই হতাশা থেকে তাৎক্ষণিক বিনোদন ও ‘রাজনৈতিক রোমাঞ্চ’ খুঁজতে অনেকে মাদক ও সহিংস কার্যকলাপে জড়ায়। পারিবারিক নজরদারির ঘাটতি এবং বন্ধুত্বের চাপে ‘চেষ্টা করে দেখো’‑মানসিকতাও বড় ভূমিকা রাখে।
একটি পরিবারের অভিজ্ঞতা
ঢাকার ধানমন্ডির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একমাত্র ছেলের ইয়াবা‑নির্ভর জীবন শুরু হয় দ্বিতীয় বর্ষে। নেশার খরচ জোগাতে গাড়ি বিক্রির পরও যখন দেনায় ডুবে যায়, তখন সে একটি ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের ‘ফান্ড রেইজিং টিমে’ যুক্ত হয়। আন্দোলনকেন্দ্রিক তহবিল তুলতে গিয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে পায়ে আঘাত পায়। বাবা‑মা এখনো তার পুনর্বাসন ও মামলার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত।
বিশেষজ্ঞ মতামত
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা হক বলেন, “পরিবারে খোলা সংলাপের অভাব ও‘একাই সব পারতে হবে’‑ধারণা দ্রুত বিষণ্ণতায় ঠেলে দেয়, যা মাদক‑রাজনীতির ফাঁদে ঢোকার প্রবণতা বাড়ায়।”
• জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সাবেক পরিচালক মেহেদী হাসান মনে করেন, “ক্যাম্পাস রাজনীতি‑কে মাদক অর্থায়ন করে, আবার মাদক সেবীরা সহিংসতার কাঁচা‑মাল; এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে উভয় সমস্যা সমন্বিতভাবে ধরতে হবে।”
করণীয় ও সুপারিশ
পরিবার‑স্কুল‑বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং সার্ভিস চালু করতে হবে।
ছাত্ররাজনীতিতে অর্থের প্রবাহ ও ক্যাম্পাসে মাদক সরবরাহ কঠোর নজরদারিতে আনতে ডিএনসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যৌথ টাস্কফোর্স গঠন জরুরি।
তরুণদের জন্য দক্ষতা‑ভিত্তিক চাকরির বাজার সম্প্রসারণ ও স্টার্ট‑আপ অনুদান বাড়ালে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কমবে।
পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিবার‑কেন্দ্রিক থেরাপি বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে অভিভাবকরাও প্রশিক্ষণ পায়।
শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মাদকাসক্তি ও সহিংস রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদনক্ষমতা নষ্ট করছে এবং সামাজিক‑রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলছে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র একসাথে এগিয়ে না এলে এ সংকট আরও তীব্র হবে, আর ভাঙন ধরবে বাংলাদেশের অগণিত পরিবারে।