০১:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

ঢাকা—যানজটের শহরে আরিফের একদিন (পর্ব-১)

এক সময় গ্রামের মেঠোপথে খাকি ব্যাগ ঝুলিয়ে যাওয়া পোস্টম্যানের পায়ের শব্দে মানুষ বুঝে নিত—চিঠি এসেছে। আজ সেই চিঠির জায়গা নিয়েছে স্ক্রিনের ‘নটিফিকেশন’, আর খাকি ব্যাগ বদলে গেছে বাইকের পিঠে বাঁধা বক্সে। এই নতুন যুগের “আধুনিক postal man”-রা হলেন আমাদের ডেলিভারি বয়—যাঁরা প্রতিদিন শহরের রক্তমোহনায় রোদ-বৃষ্টি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেন ওষুধ, খাবার, বই, কখনও বা জন্মদিনের কেক ও প্রেমিকের চমক।

ড. সৌমিক দাসের ঝাঁঝালো গানের কথায়ই তাঁদের জীবনের সুর—

আমি সেই ডেলিভারি বয়কাঁধে স্বপ্নের বাক্স,
রোদ্দুর-বৃষ্টি মুছে ছুটে চলি দিন-রাত।’’

গানের পরের পংক্তিগুলো যেন আরও স্পষ্ট করে দেয় এই পেশার না-বলা লড়াই—

দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারতারিখ শুধু বেতনহীন,
নীরব সিগন্যালে গল্প লিখে যায় হর্নের সুর।

বহুতল শহরের অগণন দরজায় তাঁদের নকই এখনকার ‘চিঠি-বেল’—

দরজায় কড়া নাড়িলিফটহীন সিঁড়ি পেরিয়ে,
বাড়ির ছাদে আলো জ্বলেফিরতি পথে একটাই ঠিকানা।

এই গান যেমন তাদের ক্লান্ত হাতের গল্প বলে, তেমনি হাড়ভাঙা খাটনি, অনিশ্চিত আয় আর ভারী ট্র্যাফিকেও লুকিয়ে থাকা দৃঢ় আশা—

ফুটপাতে ভাঙা স্বপ্নপকেটে সম্বল স্বল্প,
তবু হাসি মুখে বলে যাই—‘সার্ভিস অলওয়েজ অন-টাইম!’”

ডেলিভারি বয়রা সেই অবিরাম ছুটে চলা মানবিক সেতু, যাঁরা অফলাইনের কাঁধে অনলাইনকে বয়ে আনেন। তাঁদের আর্তি, আনন্দ, ঘাম, এবং স্বপ্ন মিলিয়ে যে কাব্য রচিত হয়, ‘ডেলিভারি বয়’ গানটি তার শব্দযাপন। এই সিরিজ-রিপোর্টে আমরা ঢাকার আরিফ থেকে সিলেটের রাজু পর্যন্ত পাঁচ শহরের পাঁচ জন ডেলিভারি বয়ের দিনমান, পরিবার, স্বপ্ন ও সংশয়ের বাঁকগুলো তুলে ধরব—আলোয়-অন্ধকারে যে জীবন, তা গানের পংক্তির মতোই সহজ-প্রাণ yet সংগ্রামী।

পাঠকের আহ্বান—চাইলে আপনি যখন পরের বার খাবার বা প্যাকেট হাতে নেবেন, মনে করবেন ওই প্যাকেটের গায়ে ভাসছে গানেরই লাইন:

আমি সেই ডেলিভারি বয়স্বপ্ন যে পৌঁছে দেই বাড়ি-বাড়ি।

বাংলাদেশের পাঁচ প্রধান সিটি’র ডেলিভারী বয়দের নিয়ে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট –


ঢাকা—যানজটের শহরে আরিফের একদিন

মিরপুর ১০-এর চিকন গলির ভেতর টিনশেড বাড়িটি অন্ধকারেই থাকে––কারণ ২২-বছরের আবদুর আরিফ ভোর ছয়টার আগেই বাইরে বেরিয়ে পড়েন। মা রওশনারা খালি হাতে বিদায় জানাতে চান না; তাই চুলার আগুনে রাখা ফুটন্ত পানিতে মুসুর ডাল আর শুকনো মরিচ ফেলে টোকলা ভাতের সঙ্গে গুলে দেন। আরিফের সকাল শুরু হয় সেই পাতলা ডাল-ভাতে, যেটি তিনি পাঁচ মিনিটে শেষ করেন; কারণ অ্যাপ খুলে “ব্রেকফাস্ট পিক” এর অপেক্ষায় আর দেরি করা চলে না।

প্রভাতের পালা (৬টা৯টা)
৬টা ২০-তে বাইকের ইঞ্জিন স্টার্ট, তবে প্রথম অর্ডার হাতে আসে প্রায় সোয়া সাতটায়, ক্যান্টনমেন্টের স্যান্ডউইচ শপ থেকে তেজগাঁওয়ের বাসায়। ঢাকা শহরের সকালের প্রধান প্রতিপক্ষ হলো ঘুরপথে জমে থাকা ঠাণ্ডা যানজট; আরিফ চার কিলোমিটার পাড়ি দিতে প্রায় ২৫ মিনিট। ঘণ্টায় দেড়-দুইটি অর্ডার নিয়েই এই পিক শেষ।

দুপুরের ঠাণ্ডা (৯টা৩টা)
১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মহাখালীর ওষুধের ফার্মেসি থেকে গুলশানে ইনসুলিন পৌঁছে দিতে হয়, যেখানে রোগীর ছেলে ফোন দিয়ে কাঁপা গলায় বলে, “ভাই, একটু তাড়া দেন।” এমন জরুরি অর্ডারে প্ল্যাটফর্ম বোনাস ১৫ টাকা যোগ করে, কিন্তু সেই বাড়তি টাকা পেট্রোলে ভেসে যায় ধানমন্ডির সিগন্যালে দাঁড়িয়ে। দুপুর ১টায় বাড়ি ফেরার সুযোগ নেই; সেজন্যই ব্যাগে থাকে ঠান্ডা চালের গুড়-মুড়ি আর এক বোতল পানি।

বিকেলের ব্যস্ততা (৩টা৭টা)
পাঁচটার পরে জ্যামের মুখে গুলশান-বনানীর প্রবাসী পরিবারের বড় অর্ডারগুলো আসে—ত্রিশ রকম খাবার, চারতলা পর্যন্ত হেঁটে তুলতে হয়। ফ্ল্যাটফি ২৫ টাকা, দূরত্বভিত্তিক ১৫, আর টিপ মিলে প্রায় ৬০ টাকা; তবে লিফট না থাকলে সময় নষ্ট দ্বিগুণ।

রাতের শেষ টান (৭টা১১টা)
প্ল্যাটফর্মে “ডিনার বুস্ট” চালু হলে তিন ঘণ্টায় পাঁচ-ছয়টি শিফট টিকিট পান; রাত ১১টায় শেষ অর্ডার মাথায় নিয়ে ফিরতি পথে র‌্যামপাড়া জ্যামে আটকে থাকেন আধা ঘণ্টা। বাড়ির গলি ঢুকে বাইক আর পার্কিং খরচ না রাখতে পারায় তিনি উৎসুক শিশুদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দিয়ে ঢুকিয়ে রাখেন দরজার পাশে।

পরিবারের ছায়া
সিঁড়ি বেয়ে দরজা ঠেলে ঢুকতেই মা এক গ্লাস গরম দুধ বাড়িয়ে দেন; বাবা ফিরেছেন রাতেই ভাড়ায় চালিত রিকশা রেখে। ছোট বোন সুমাইয়া দ্বিতীয় শিফটের কোচিং সেরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। পরিবারের আয়ের ৭০ শতাংশই এখন আরিফের বাইকের খরচা বাঁচিয়ে হাতে থাকে; মাসে মোট আয় ৩৩-৩৫ হাজার টাকা, খরচ বাদে ১৮-১৯ হাজার যায় সংসারে, বোনের টিউশন আর বাবার ঔষধে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে আরিফের কথা
“ক্লাচ-ব্রেকে হাতের কবজি যখন ব্যথা করে, মনে হয় ড্রোন আসবে, আমরা চাকরি হারাব। তাই ইউটিউবে কোড শেখা শুরু করেছি; কিন্তু নেটের ব্যালেন্সই তো শেষ হয়ে যায়,”—হাসতে-হাসতে বলে আরিফ। তার স্বপ্ন, কোনোদিন রাত ১১টায় নয়, সন্ধ্যা ৭টায়ই ঘরে ফিরবেন, মা-বাবাকে নিয়ে তিনখান কক্ষের ফ্ল্যাটে থাকবেন, আর বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন। কিন্তু তার চোখের সামনে, ঢাকা শহরের যানজটের মতোই ভবিষ্যৎও যানজটে আটকে থাকে।

ঢাকা—যানজটের শহরে আরিফের একদিন (পর্ব-১)

০৬:০৬:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

এক সময় গ্রামের মেঠোপথে খাকি ব্যাগ ঝুলিয়ে যাওয়া পোস্টম্যানের পায়ের শব্দে মানুষ বুঝে নিত—চিঠি এসেছে। আজ সেই চিঠির জায়গা নিয়েছে স্ক্রিনের ‘নটিফিকেশন’, আর খাকি ব্যাগ বদলে গেছে বাইকের পিঠে বাঁধা বক্সে। এই নতুন যুগের “আধুনিক postal man”-রা হলেন আমাদের ডেলিভারি বয়—যাঁরা প্রতিদিন শহরের রক্তমোহনায় রোদ-বৃষ্টি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেন ওষুধ, খাবার, বই, কখনও বা জন্মদিনের কেক ও প্রেমিকের চমক।

ড. সৌমিক দাসের ঝাঁঝালো গানের কথায়ই তাঁদের জীবনের সুর—

আমি সেই ডেলিভারি বয়কাঁধে স্বপ্নের বাক্স,
রোদ্দুর-বৃষ্টি মুছে ছুটে চলি দিন-রাত।’’

গানের পরের পংক্তিগুলো যেন আরও স্পষ্ট করে দেয় এই পেশার না-বলা লড়াই—

দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারতারিখ শুধু বেতনহীন,
নীরব সিগন্যালে গল্প লিখে যায় হর্নের সুর।

বহুতল শহরের অগণন দরজায় তাঁদের নকই এখনকার ‘চিঠি-বেল’—

দরজায় কড়া নাড়িলিফটহীন সিঁড়ি পেরিয়ে,
বাড়ির ছাদে আলো জ্বলেফিরতি পথে একটাই ঠিকানা।

এই গান যেমন তাদের ক্লান্ত হাতের গল্প বলে, তেমনি হাড়ভাঙা খাটনি, অনিশ্চিত আয় আর ভারী ট্র্যাফিকেও লুকিয়ে থাকা দৃঢ় আশা—

ফুটপাতে ভাঙা স্বপ্নপকেটে সম্বল স্বল্প,
তবু হাসি মুখে বলে যাই—‘সার্ভিস অলওয়েজ অন-টাইম!’”

ডেলিভারি বয়রা সেই অবিরাম ছুটে চলা মানবিক সেতু, যাঁরা অফলাইনের কাঁধে অনলাইনকে বয়ে আনেন। তাঁদের আর্তি, আনন্দ, ঘাম, এবং স্বপ্ন মিলিয়ে যে কাব্য রচিত হয়, ‘ডেলিভারি বয়’ গানটি তার শব্দযাপন। এই সিরিজ-রিপোর্টে আমরা ঢাকার আরিফ থেকে সিলেটের রাজু পর্যন্ত পাঁচ শহরের পাঁচ জন ডেলিভারি বয়ের দিনমান, পরিবার, স্বপ্ন ও সংশয়ের বাঁকগুলো তুলে ধরব—আলোয়-অন্ধকারে যে জীবন, তা গানের পংক্তির মতোই সহজ-প্রাণ yet সংগ্রামী।

পাঠকের আহ্বান—চাইলে আপনি যখন পরের বার খাবার বা প্যাকেট হাতে নেবেন, মনে করবেন ওই প্যাকেটের গায়ে ভাসছে গানেরই লাইন:

আমি সেই ডেলিভারি বয়স্বপ্ন যে পৌঁছে দেই বাড়ি-বাড়ি।

বাংলাদেশের পাঁচ প্রধান সিটি’র ডেলিভারী বয়দের নিয়ে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট –


ঢাকা—যানজটের শহরে আরিফের একদিন

মিরপুর ১০-এর চিকন গলির ভেতর টিনশেড বাড়িটি অন্ধকারেই থাকে––কারণ ২২-বছরের আবদুর আরিফ ভোর ছয়টার আগেই বাইরে বেরিয়ে পড়েন। মা রওশনারা খালি হাতে বিদায় জানাতে চান না; তাই চুলার আগুনে রাখা ফুটন্ত পানিতে মুসুর ডাল আর শুকনো মরিচ ফেলে টোকলা ভাতের সঙ্গে গুলে দেন। আরিফের সকাল শুরু হয় সেই পাতলা ডাল-ভাতে, যেটি তিনি পাঁচ মিনিটে শেষ করেন; কারণ অ্যাপ খুলে “ব্রেকফাস্ট পিক” এর অপেক্ষায় আর দেরি করা চলে না।

প্রভাতের পালা (৬টা৯টা)
৬টা ২০-তে বাইকের ইঞ্জিন স্টার্ট, তবে প্রথম অর্ডার হাতে আসে প্রায় সোয়া সাতটায়, ক্যান্টনমেন্টের স্যান্ডউইচ শপ থেকে তেজগাঁওয়ের বাসায়। ঢাকা শহরের সকালের প্রধান প্রতিপক্ষ হলো ঘুরপথে জমে থাকা ঠাণ্ডা যানজট; আরিফ চার কিলোমিটার পাড়ি দিতে প্রায় ২৫ মিনিট। ঘণ্টায় দেড়-দুইটি অর্ডার নিয়েই এই পিক শেষ।

দুপুরের ঠাণ্ডা (৯টা৩টা)
১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মহাখালীর ওষুধের ফার্মেসি থেকে গুলশানে ইনসুলিন পৌঁছে দিতে হয়, যেখানে রোগীর ছেলে ফোন দিয়ে কাঁপা গলায় বলে, “ভাই, একটু তাড়া দেন।” এমন জরুরি অর্ডারে প্ল্যাটফর্ম বোনাস ১৫ টাকা যোগ করে, কিন্তু সেই বাড়তি টাকা পেট্রোলে ভেসে যায় ধানমন্ডির সিগন্যালে দাঁড়িয়ে। দুপুর ১টায় বাড়ি ফেরার সুযোগ নেই; সেজন্যই ব্যাগে থাকে ঠান্ডা চালের গুড়-মুড়ি আর এক বোতল পানি।

বিকেলের ব্যস্ততা (৩টা৭টা)
পাঁচটার পরে জ্যামের মুখে গুলশান-বনানীর প্রবাসী পরিবারের বড় অর্ডারগুলো আসে—ত্রিশ রকম খাবার, চারতলা পর্যন্ত হেঁটে তুলতে হয়। ফ্ল্যাটফি ২৫ টাকা, দূরত্বভিত্তিক ১৫, আর টিপ মিলে প্রায় ৬০ টাকা; তবে লিফট না থাকলে সময় নষ্ট দ্বিগুণ।

রাতের শেষ টান (৭টা১১টা)
প্ল্যাটফর্মে “ডিনার বুস্ট” চালু হলে তিন ঘণ্টায় পাঁচ-ছয়টি শিফট টিকিট পান; রাত ১১টায় শেষ অর্ডার মাথায় নিয়ে ফিরতি পথে র‌্যামপাড়া জ্যামে আটকে থাকেন আধা ঘণ্টা। বাড়ির গলি ঢুকে বাইক আর পার্কিং খরচ না রাখতে পারায় তিনি উৎসুক শিশুদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দিয়ে ঢুকিয়ে রাখেন দরজার পাশে।

পরিবারের ছায়া
সিঁড়ি বেয়ে দরজা ঠেলে ঢুকতেই মা এক গ্লাস গরম দুধ বাড়িয়ে দেন; বাবা ফিরেছেন রাতেই ভাড়ায় চালিত রিকশা রেখে। ছোট বোন সুমাইয়া দ্বিতীয় শিফটের কোচিং সেরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। পরিবারের আয়ের ৭০ শতাংশই এখন আরিফের বাইকের খরচা বাঁচিয়ে হাতে থাকে; মাসে মোট আয় ৩৩-৩৫ হাজার টাকা, খরচ বাদে ১৮-১৯ হাজার যায় সংসারে, বোনের টিউশন আর বাবার ঔষধে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে আরিফের কথা
“ক্লাচ-ব্রেকে হাতের কবজি যখন ব্যথা করে, মনে হয় ড্রোন আসবে, আমরা চাকরি হারাব। তাই ইউটিউবে কোড শেখা শুরু করেছি; কিন্তু নেটের ব্যালেন্সই তো শেষ হয়ে যায়,”—হাসতে-হাসতে বলে আরিফ। তার স্বপ্ন, কোনোদিন রাত ১১টায় নয়, সন্ধ্যা ৭টায়ই ঘরে ফিরবেন, মা-বাবাকে নিয়ে তিনখান কক্ষের ফ্ল্যাটে থাকবেন, আর বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন। কিন্তু তার চোখের সামনে, ঢাকা শহরের যানজটের মতোই ভবিষ্যৎও যানজটে আটকে থাকে।