শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক একসময় ছিল শৃঙ্খলা ও শ্রদ্ধার প্রতীক। শিক্ষক ছিলেন আলোর দিশারি, আর ছাত্র ছিলেন শ্রদ্ধাভক্ত অনুসারী। কিন্তু ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউ এসে সেই সম্পর্ককে ভয়ঙ্করভাবে বদলে দিয়েছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা ঘটেছে, তা শুধু শিক্ষকদের ব্যক্তিগত অপমান নয়—এটি শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চরিত্র গঠনের এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের ইঙ্গিত।
জুলাই আন্দোলনের পর ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের পদত্যাগ
২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকারের পতনের পরে দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে এক নতুন রূপের হিংসা—ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের ঘেরাও, অপমান এবং পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা। ঢাকা, বরিশাল, জামালপুর, এমনকি দেশের স্বনামধন্য স্কুল ও কলেজেও এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে যেন আগুনের মতো।
১৮ আগস্ট ২০২৪, ঢাকার আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজে এমনই এক ঘটনা ঘটে। এখানে তিনজন শিক্ষক—প্রধান শিক্ষক গীতাঞ্জলি বড়ুয়া, সহকারী প্রধান শিক্ষক গৌতম চন্দ্র পাল এবং ক্রীড়া শিক্ষিকা শাহনাজা আখতারকে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে বের করে দেয়, তাদের চারপাশ ঘিরে স্লোগান দেয় এবং পরবর্তীতে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করে। বিষয়টি ছিল এমনই তীব্র, যে শিক্ষকরা শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। অধ্যক্ষ শুক্লা রাণী হালদারকে একদল ছাত্র এবং কিছু স্থানীয় উসকানিদাতার সহায়তায় ঘেরাও করে রাখা হয় টানা চার ঘণ্টা, এরপর তার ওপর মানসিক চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজেও অধ্যক্ষ কেকা রায় এবং সহকারী অধ্যাপক ফারহানা খানমকে ছাত্রদের উত্তেজিত ভিড় ঘেরাও করে। যে প্রতিষ্ঠান একসময় কঠোর শৃঙ্খলা ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য পরিচিত ছিল—সেখানেও এ রকম অপমানজনক পরিস্থিতি শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করে।
অক্টোবর মাসে ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ কাজী নিয়ামুল হক ও উপাধ্যক্ষ মোখলেসুর রহমানের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংযোগ ও অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ তুলে প্রায় ১৮ দিন কলেজের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। এই ধরনের ‘ছাত্র-আন্দোলন’ বাস্তবে হয়ে ওঠে নেতৃত্বহীন উত্তেজনার বিস্ফোরণ।
জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজাব আলীও একই কায়দায় ছাত্রদের ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। এসব ঘটনায় একটি চিত্র স্পষ্ট হয়—শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মব হিংসা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়, এটি একটি নতুন সামাজিক বাস্তবতা।
শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ভয়াবহ অবক্ষয়
একসময় শিক্ষক ছিলেন পিতৃতুল্য, সম্মানের প্রতীক। আজ সেই শিক্ষককেই ছাত্ররা গালি দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে, ক্লাস থেকে বের করে দিচ্ছে। এমন দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজকে ছোট করে দেয়। শিক্ষকরা এখন ক্লাসে সত্য বলা বা শৃঙ্খলা রক্ষা করার সাহস হারাচ্ছেন। একজন কলেজ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখন প্রশ্ন করতে ভয় লাগে, কারণ কেউ কিছু মনে করলে সেটা আন্দোলনে রূপ নেয়।”
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. রেজাউল করিম বলেন, “এইসব ঘটনা আমাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ অন্ধকার করছে। যেখানে ছাত্ররাই নিয়ম ভাঙছে, সেখানে শিক্ষা আর কীভাবে হবে?”
সমাজে নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের পতন
এই ছাত্রদের অনেকেই জানে না কীভাবে একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তারা অভিভাবকদের কাছ থেকেও শিখছে না সম্মান, বিনয় কিংবা সহনশীলতা। ফলে স্কুল-কলেজগুলো হয়ে উঠছে অস্থিরতার কেন্দ্র। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক উসকানি, বিভাজনের বীজ বপন করছে কুচক্রী মহল। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে—ছাত্রদের পেছনে সক্রিয় ছিল রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠী, যারা শিক্ষককে হিন্দু হওয়া বা অন্যমত পোষণ করার কারণে টার্গেট করছিল।
একজন অভিভাবক বলেন, “আমার ছেলেকে আমি শিক্ষা দিয়েছিলাম মাথা নিচু করে শিক্ষকের কথা শুনতে। এখন সে নিজেই শিক্ষককে হুমকি দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে এই পরিবর্তন হলো।”
ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত
এখন যে ছাত্র শিক্ষককে গালি দিচ্ছে, ভবিষ্যতে সে অফিসে বস, পিতামাতা বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বকেও সম্মান করবে না। এই ধ্বংস শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, এটি ভবিষ্যৎ সমাজকে নেতৃত্বহীন, নীতিহীন ও সহিংস করে তুলবে। একবার যদি এই ‘মব সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠা পায়, তবে আগামী প্রজন্ম যুক্তি দিয়ে নয়, জোরে, স্লোগানে এবং ভয় দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিখবে। সে সমাজে আর জ্ঞান, যুক্তি ও শৃঙ্খলার জায়গা থাকবে না।
জাতির আত্মাও হারায়
শিক্ষকের মর্যাদা হারিয়ে গেলে একটি জাতির আত্মাও হারায়। শিক্ষকদের অপমান করে, ছাত্রদের মব হিংসা দিয়ে, আমরা যে ‘বিপজ্জনক প্রজন্ম’ গড়ে তুলছি, তার ফল শুধু আজ নয়, আগামী দশকগুলোতে ভয়ঙ্করভাবে ফিরে আসবে। এখনই যদি এই প্রবণতা রোধ না করা হয়, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান কমে যাবে, শিক্ষক হয়ে উঠবে ভীতসন্ত্রস্ত এক কর্মচারী, আর ছাত্র হয়ে উঠবে অপরিণত এক নেতা—যার হাতে থাকবে স্লোগান, কিন্তু থাকবে না শ্রদ্ধাবোধ।
এখন সময়—সমাজ, রাষ্ট্র ও অভিভাবকদের একসাথে দাঁড়ানোর। শিক্ষককে সুরক্ষা দিতে না পারলে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ একটি অন্ধ, অবিনিয়ন্ত্রিত সমাজে পরিণত হবে—যেখানে জ্ঞান নয়, রাজপথই নির্ধারণ করবে কে সঠিক আর কে নয়।