গত বছর আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান আরও সুসংহত করছে বলে মনে হয়েছিল। অন্যান্য বড় অর্থনীতির তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনীতি ২০২৪ সালের শেষার্ধে ডলারের মান প্রায় দশ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ট্রাম্পের অভিষেকের আগ-পিছে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার ভাল পারফর্ম করছিল, আর মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে ফেডারেল রিজার্ভের দুই শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার দিকে নামছিল।
তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে সন্দেহের বীজ বপন করেন। ২ এপ্রিল ঘোষিত ‘লিবারেশন ডে’ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি সব বাণিজ্য অংশীদারের ওপর সমহারে শুল্ক বসান, যা বিশ্ব বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা তোলে এবং আর্থিক বাজারকে কাঁপিয়ে দেয়। হোয়াইট হাউস পরে কিছু শুল্ক কমালেও ক্ষতি বহু আগেই হয়ে গেছে। এ অনিশ্চয়তা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, কারণ প্রায় সব আমদানি-রপ্তানি এর আওতায়। ফলে অর্থনীতিকে চাঙা করতে ফেডারেল রিজার্ভকে বছর শেষ নাগাদ সুদ হার নামাতে হতে পারে—এ প্রত্যাশায় ডলারের মান ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরের পূর্ব-অবস্থানে ফিরে গেছে।
এই ঘটনায় ডলারকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত দুই দশকে প্রতিবার বৈশ্বিক অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিহীন মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটিজে ছুটেছেন। এর ফলে তাদের দাম বেড়েছে, সুদ কমেছে, এবং ডলারের মান শক্তিশালী হয়েছে।
কিন্তু এবার ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীরা ডলার ছেড়ে জাপানি সরকারি বন্ড ও সোনায় ঝুঁকেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সুদ—বিশেষত দশ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ফলন—লাফিয়ে উঠেছে। তদুপরি, আগের সঙ্কটগুলোয় স্থিত ডলারের বিনিময় হার এবার পড়ে গেছে।
ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি, ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতার ওপর হামলা এবং আইনের শাসনে আঘাত শুধু ডলারের বিনিময় দরকে নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি আধিপত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ভিতকেও দুর্বল করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে লেনদেন, মূল্যনির্ধারণ ও রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের রাজত্বের পতন আসন্ন বলেই মনে হতে পারে। ডলারকে ইচ্ছামতো দুর্বল করতে অন্য দেশের সহযোগিতা চাওয়ার ট্রাম্পের ভাবনাও এ ঝুঁকি বাড়ায়।
তা সত্ত্বেও, ডলারকে সিংহাসনচ্যুত করার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কি না, তা অন্য দেশের প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে। কিন্তু চীন, জাপান বা ইউরোজোনের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এখনো কম আকর্ষণীয়। কোথাও ধীর প্রবৃদ্ধি, কোথাও পুঁজির প্রবেশ-বাহিরে বিধিনিষেধ, কোথাও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের দূরে রাখছে।
ডলারের শীর্ষস্থান কখনো এতটা নড়বড়ে দেখায়নি। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে আপাতত তাকে হটিয়ে দেওয়া কঠিন।
অব্যাহত পতনের দৌড়
কয়েক মাস ধরে ডলার ছেড়ে বিকল্প সম্পদে ঝোঁকার প্রবণতা নতুন ধারা নাকি কেবল প্রযুক্তিগত ও সামষ্টিক-অর্থনৈতিক কারণে—এ প্রশ্ন এখনো উন্মুক্ত। ট্রাম্পের শুল্কের পর প্রবৃদ্ধি ও সুদের পূর্বাভাস বদলায়; এতে মার্কিন ট্রেজারি নিয়ে অতিরিক্ত ঋণভিত্তিক অবস্থান নেয়া হেজ ফান্ডগুলো দ্রুত অংশীদারিত্ব বিক্রি করে। পাশাপাশি উচ্চতর মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশায় সরকারি ঋণে বিনিয়োগকারীরা বেশি সুদ দাবি করছেন। ফেডারেল ঋণ অস্বাভাবিক উচ্চ এবং শুল্ক মূল্যস্ফীতি বাড়াবে—এ সবই সুদ বাড়ার পক্ষে কাজ করছে।
ডলার ছেড়ে বিকল্প সম্পদে যাওয়ার আরেক কারণ পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যায়ন। কোনো এক দেশে বা মুদ্রায় সম্পদের অর্ধেকের বেশি রাখলে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়ে, আর ট্রাম্পের সময় এসব ঝুঁকি বেড়েছে। ফলে বিকল্প সম্পদে বিনিয়োগ বাড়াকে কৌশলগত রক্ষণাবেক্ষণ হিসেবেই দেখা যায়।
তবে এ পরিবর্তন সীমিত হতে পারে, কারণ অন্য দেশগুলোর বাজারে বিপুল মূলধন শোষণের মতো গভীরতা ও তারল্য নেই। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আন্তঃদেশীয় পেমেন্ট ব্যবস্থাকে নিকটতর করলেও, ডলারের লেনদেন মুদ্রা হিসেবে ভূমিকায় অবক্ষয়ের সপক্ষে বাস্তব প্রমাণ মেলেনি। ডলার এখনও প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেক এগিয়ে।
অবশ্য ব্যবধান সঙ্কুচিত হচ্ছে। ইতিহাসে দেখা যায়, শক্তিমত্তার ভিত ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ মুহূর্তে দ্রুত ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো—ডলারের আধিপত্যের মূলস্তম্ভ—ট্রাম্পের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত; ফেডের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে ডলারের দীর্ঘমেয়াদি মূল্যে বিনিয়োগকারীর আস্থাতেও চিড় ধরতে পারে।
শীর্ষে একাকী
তবে ডলারের আধিপত্যের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর সময় এখনো আসেনি; বিকল্প রিজার্ভ মুদ্রাগুলোর ভঙ্গুরতা ও অস্থির সময়ে নিরাপদ সম্পদের তীব্র চাহিদা একে টিকিয়ে রাখবে। জাপানি সরকারি বন্ড ও ইউরোজোনের মূল কিছু দেশের বন্ড নিরাপদ ও গভীর হলেও দুর্বল প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
চীনের অর্থনীতি রিয়েল এস্টেট সংকট, বিপুল ঋণনির্ভর অকার্যকর বিনিয়োগ ও মূল্যপতনের আশঙ্কায় নাভিশ্বাস ফেলছে। আইনি-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কঠিন নিয়ন্ত্রণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভঙ্গ করেছে।
সুতরাং ডলারের স্থানে আপাত নড়াচড়া থাকলেও, বিকল্প শক্ত মুদ্রার অভাবে এটি এখনও নিরাপদ। বরাবরের মতোই, এটি ‘আমেরিকান ব্যতিক্রমীতা’র ফল নয়; বরং বাকি বিশ্বের মৌলিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতিফলন। এসব পরিবর্তন না এলে ডলার তার প্রাপ্যর তুলনায় অনেক দীর্ঘ দড়িতে বাঁধা থাকবে।