০৫:৫০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

ঘেরের বেড়া—দৈনন্দিনতার নতুন শেকল (দ্বিতীয় পর্ব)

লনার নিম্নাঞ্চলের বুকে বর্ণাঢ্য শস্যচাষের একসময় সোনালী অধ্যায় ছিলধানক্ষেতের শ্যামল রেখাকলাবাগানের ঝর্ণাধারভুট্টার সোনালি গ্রন্থি আর নানা রঙের শাকসবজির সারি। সেই জমিতে আজকের চিত্র যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার আভাস: লবণজলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়ে উঠছে চিংড়ি পুকুরআর পুরনো ফসলেরা পরিচ্ছন্নতা হারিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ছায়া ফেলে।

গত দশক জুড়ে হয়ে উঠেছে চিংড়ি বিপ্লব। ঝড়ের গতিতে বেড়েছে চিংড়ি চাষের পুকুরঅর্থনৈতিক উৎসাহকেই প্রধান প্রেরণা হিসেবে নিয়েছে স্থানীয় কৃষক। কিন্তু এই লাভের সঙ্গে পিছনে ফেলে এসেছে ভাতশাকসবজি ও মৌসুমী ফলের রসালো বৈচিত্র্যযে ফসলগুলো একসময় বাজার এবং ঘরের খাদ্যতালিকাকে সুষম করে তুলত। ফলস্বরূপগৃহস্থ শিশুদের চলছে মৌসুমী ফলাবর্জনার দুঃখসেসব আমলিচুবিভিন্ন ফল এখন ইতিহাসের পাতায় রূপ নিয়েছে।

এই পাঁচ পর্বের সিরিজে আমরা অনুসন্ধান করবো: কী করে খুলনার কৃষকদের জীবিকা বদলে দিয়েছে চিংড়ির উচ্চমূল্যহারিয়ে যাওয়া ফসলগুলো ফিরিয়ে আনতে কি কোনো পথ রয়েছেখাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সংকটের মুখে গ্রামের মানুষদের সংগ্রামপাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাবসামুদ্রিক লবণের ছোঁয়া আর সরকারের কৃষি নীতি কতটা ভূমিকা রাখছে এই পরিবর্তনে। থাকছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গল্প এবং বাস্তবতার চিত্রযার আলোকে আমরা তুলে ধরব চিংড়ি চাষের অজানা দিক এবং সম্ভাব্য সমাধান।


পাইকগাছার আলমপুর গ্রাম। ভোর ৫টায় ঘেরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ৩৫-বছরের সোহেল গাজী; জোয়ারের পানির মাত্রা দেখে বাঁশের স্লুইস খুলবেন কি না ভেবে। “ধান আবাদে সূর্য-বৃষ্টি দেখতাম, এখন লবণের মাত্রা দেখেই সিদ্ধান্ত,” বলেন তিনি। একচেটিয়া চিংড়ি চাষ তাঁর দিনে মাত্র দুই-বার ঘের টহল, পানিতে চুন-ঔষধ ছিটানো আর মাঝেমধ্যে পোস্ট-লার্ভা ছাড়ার কাজ। কাজের চাপ কমলে কী হয়—আয়ের অনিশ্চয়তাই এখন বড় শত্রু।

ফিড, পাম্প, ঔষধের দাম বেড়েছে, এপ্রিল থেকে গড়ে ১২ শতাংশ। তার ওপরে হোয়াইট-স্পট ভাইরাসের ভয়। সর্বশেষ মার্চে জেলার ৩৭ শতাংশ ঘের আক্রান্ত হয়ে ক্ষতির অঙ্ক ৭০০ কোটি টাকায় ঠেকে বলে মৎস্য দপ্তরের প্রাথমিক হিসাব। সোহেল গাজীর ভাষায়, “একবার ভাইরাস ধরা পড়লে সব শেষ—ধানের মতো সীড সংরক্ষণ করে নতুন করে শুরু করার পথ নেই।”

অন্যদিকে নারী-শ্রমিকরা পুরোপুরি কাজ হারিয়েছেন। আগে রোপা-ধানের চারা তুলতে, আগাছা পরিষ্কার করতে ও মাড়াই করতে যে ৮-১০ জন নারী সারাদিন কাজ করতেন, তাদের এখন চিংড়ি ডিপোতে বরফ ভাঙা কিংবা প্যাকেট বানানোর খণ্ডকালীন শ্রমই ভরসা। প্রতিদিনের মজুরি ৪০০ টাকা থেকে নেমে এসেছে ২৭০ টাকায়।

সেচনির্ভর ধান থেকে লবণাক্ত জলাধারের ঘেরে রূপান্তর শুধু পেশা নয়, সামাজিক সম্পর্কও বদলে দিয়েছে। ঘেরে জমি লাগতে হলে পাশের খেতের সীমানা ভেঙে একসঙ্গে জলাধার বানাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে জমির সীমানা-বিবাদ থেকে ভাই-ভাইয়ে বিরোধ, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এগুলো সামাল দিতে স্থানীয় সমিতি ও কিছু এনজিও বিকল্প প্রকল্প—যেমন ধান-চিংড়ি সমন্বিত পদ্ধতি বা সুপার-ইনটেনসিভ ভ্যানামি—এগিয়ে আনছে। তবে সেগুলির উচ্চ-প্রযুক্তি ও খরচ দেখে ক্ষুদ্র চাষিরা আগ্রহী হলেও সক্ষম নন। ফলে অনিশ্চয়তার বোঝাই ঘেরে আটকে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ। পরের পর্বে থাকছে—খাদ্যনিরাপত্তার সংকট কীভাবে আরও তীব্র হয়েছে।

ঘেরের বেড়া—দৈনন্দিনতার নতুন শেকল (দ্বিতীয় পর্ব)

০৬:০০:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

লনার নিম্নাঞ্চলের বুকে বর্ণাঢ্য শস্যচাষের একসময় সোনালী অধ্যায় ছিলধানক্ষেতের শ্যামল রেখাকলাবাগানের ঝর্ণাধারভুট্টার সোনালি গ্রন্থি আর নানা রঙের শাকসবজির সারি। সেই জমিতে আজকের চিত্র যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার আভাস: লবণজলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়ে উঠছে চিংড়ি পুকুরআর পুরনো ফসলেরা পরিচ্ছন্নতা হারিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ছায়া ফেলে।

গত দশক জুড়ে হয়ে উঠেছে চিংড়ি বিপ্লব। ঝড়ের গতিতে বেড়েছে চিংড়ি চাষের পুকুরঅর্থনৈতিক উৎসাহকেই প্রধান প্রেরণা হিসেবে নিয়েছে স্থানীয় কৃষক। কিন্তু এই লাভের সঙ্গে পিছনে ফেলে এসেছে ভাতশাকসবজি ও মৌসুমী ফলের রসালো বৈচিত্র্যযে ফসলগুলো একসময় বাজার এবং ঘরের খাদ্যতালিকাকে সুষম করে তুলত। ফলস্বরূপগৃহস্থ শিশুদের চলছে মৌসুমী ফলাবর্জনার দুঃখসেসব আমলিচুবিভিন্ন ফল এখন ইতিহাসের পাতায় রূপ নিয়েছে।

এই পাঁচ পর্বের সিরিজে আমরা অনুসন্ধান করবো: কী করে খুলনার কৃষকদের জীবিকা বদলে দিয়েছে চিংড়ির উচ্চমূল্যহারিয়ে যাওয়া ফসলগুলো ফিরিয়ে আনতে কি কোনো পথ রয়েছেখাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সংকটের মুখে গ্রামের মানুষদের সংগ্রামপাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাবসামুদ্রিক লবণের ছোঁয়া আর সরকারের কৃষি নীতি কতটা ভূমিকা রাখছে এই পরিবর্তনে। থাকছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গল্প এবং বাস্তবতার চিত্রযার আলোকে আমরা তুলে ধরব চিংড়ি চাষের অজানা দিক এবং সম্ভাব্য সমাধান।


পাইকগাছার আলমপুর গ্রাম। ভোর ৫টায় ঘেরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ৩৫-বছরের সোহেল গাজী; জোয়ারের পানির মাত্রা দেখে বাঁশের স্লুইস খুলবেন কি না ভেবে। “ধান আবাদে সূর্য-বৃষ্টি দেখতাম, এখন লবণের মাত্রা দেখেই সিদ্ধান্ত,” বলেন তিনি। একচেটিয়া চিংড়ি চাষ তাঁর দিনে মাত্র দুই-বার ঘের টহল, পানিতে চুন-ঔষধ ছিটানো আর মাঝেমধ্যে পোস্ট-লার্ভা ছাড়ার কাজ। কাজের চাপ কমলে কী হয়—আয়ের অনিশ্চয়তাই এখন বড় শত্রু।

ফিড, পাম্প, ঔষধের দাম বেড়েছে, এপ্রিল থেকে গড়ে ১২ শতাংশ। তার ওপরে হোয়াইট-স্পট ভাইরাসের ভয়। সর্বশেষ মার্চে জেলার ৩৭ শতাংশ ঘের আক্রান্ত হয়ে ক্ষতির অঙ্ক ৭০০ কোটি টাকায় ঠেকে বলে মৎস্য দপ্তরের প্রাথমিক হিসাব। সোহেল গাজীর ভাষায়, “একবার ভাইরাস ধরা পড়লে সব শেষ—ধানের মতো সীড সংরক্ষণ করে নতুন করে শুরু করার পথ নেই।”

অন্যদিকে নারী-শ্রমিকরা পুরোপুরি কাজ হারিয়েছেন। আগে রোপা-ধানের চারা তুলতে, আগাছা পরিষ্কার করতে ও মাড়াই করতে যে ৮-১০ জন নারী সারাদিন কাজ করতেন, তাদের এখন চিংড়ি ডিপোতে বরফ ভাঙা কিংবা প্যাকেট বানানোর খণ্ডকালীন শ্রমই ভরসা। প্রতিদিনের মজুরি ৪০০ টাকা থেকে নেমে এসেছে ২৭০ টাকায়।

সেচনির্ভর ধান থেকে লবণাক্ত জলাধারের ঘেরে রূপান্তর শুধু পেশা নয়, সামাজিক সম্পর্কও বদলে দিয়েছে। ঘেরে জমি লাগতে হলে পাশের খেতের সীমানা ভেঙে একসঙ্গে জলাধার বানাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে জমির সীমানা-বিবাদ থেকে ভাই-ভাইয়ে বিরোধ, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এগুলো সামাল দিতে স্থানীয় সমিতি ও কিছু এনজিও বিকল্প প্রকল্প—যেমন ধান-চিংড়ি সমন্বিত পদ্ধতি বা সুপার-ইনটেনসিভ ভ্যানামি—এগিয়ে আনছে। তবে সেগুলির উচ্চ-প্রযুক্তি ও খরচ দেখে ক্ষুদ্র চাষিরা আগ্রহী হলেও সক্ষম নন। ফলে অনিশ্চয়তার বোঝাই ঘেরে আটকে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ। পরের পর্বে থাকছে—খাদ্যনিরাপত্তার সংকট কীভাবে আরও তীব্র হয়েছে।