০৯:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫
রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৭) মৃত্যুর মিছিল থামছেই না: সাভারে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ দম্পতি ব্ল্যাকপিংকের ‘জাম্প’ গানে বড় ধরনের হ্যাকিং, একাধিক প্ল্যাটফর্মে বিশৃঙ্খলা ফুটপাথের চার বিক্রেতা ও চাঁদাবাজির ভয়াবহ বাস্তবতা শীতল ও কালোপানির কুমার নদ হাসান ইমাম: মঞ্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ—এক সংগ্রামী শিল্পীর অভিযাত্রা এক বছর বয়সী বাচ্চার কামড়ে সাপের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক: বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের ওপর প্রভাব আইকনিক পার্সোনালিটি হিসেবে ডা. সাকিরা নোভার ময়ূরপঙ্খী স্টার অ্যাওয়ার্ড অর্জন দক্ষিণ জার্মানিতে ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত তিনজন নিহত

বাংলাদেশ : সমান হিস্যা চাওয়াও নারীর ‘অপরাধ’?

‘হিস্যা’ নামের ম্যাগাজিনের এক প্রবন্ধে নারী-পুরুষের সমান হিস্যার কথা লিখেছিলেন নাদিরা ইয়াসমিন৷ তাতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ও চাকরিচ্যুত করার দাবিতে মিছিল৷

সমান অধিকার দাবি করে নাদিরা ইয়াসমিন এখন বিপদে৷ হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে নরসিংদী সরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক নাদিরাকে ওএসডি করে বদলি করা হয়েছে৷ সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে যেতে হবে তাকে৷ রাতারাতি বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে বড় বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি৷

হেফাজতে ইসলামী ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, সাতক্ষীরা কলেজেও নাদিরা ইসলামকে যোগ দিতে দেয়া হবে না।হেফাজতের নরসিংদী জেলা শাখার মহাসচিব মাওলানা ইসমাইল হোসেন নূরপুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “শুধু বদলি করলে তো হবে না। আমরা তাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়ার দাবি করেছি। তাকে আরো বড় শাস্তি দিতে হবে।”

নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, নাদিরা ইয়াসমিনের শাস্তি যারা চেয়েছেন, তাদেরই শাস্তি হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু তাদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো নাদিরাকে শাস্তি দিয়েছে সরকার। তারা মনে করেন,

সরকারের এই অবস্থান উগ্রবাদীদের আরো বেপরোয়া করবে, কলেজ শিক্ষিকা নাদিরা হয়ত আরো বড় হুমকির মুখে পড়বেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উগ্রবাদীদের পক্ষাবলম্বন করছে বলেও মনে করেন তারা, কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে  হেফাজতের সমাবেশে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও  নারীদের নিয়ে অশ্লীল ভাষায় কথা সত্ত্বেও

সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি, এমন অশালীন আচরণের প্রতিবাদে কোনো বিবৃতিও দেয়নি।

নরসিংদীতে শিক্ষিকা নাদিরা যা করেছিলেন

নরসিংদী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের  সহকারি অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিন প্রায় ১১ বছর ধরে ওই কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তার বাড়িও নরসিংদীতে। নারী অধিকার কর্মী হিসাবেও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তিনি। ‘নারী অঙ্গন’ নামের একটি সংগঠন পরিচালনা করেন। ওই নামে একটি ওয়েব পোর্টালও আছে।  মাস  খানেক আগে ‘হিস্যা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে নারী অধিকার নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। কী লিখেছিলেন সেখানে? নাদিরা ইয়াসমিন এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” সেখানে আমি নারী-পুরুষের সমান হিস্যার কথা বলেছি। এটাই আমার অপরাধ।” ওই  লেখার পর স্থানীয় উগ্রবাদীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননা অভিযোগ তুলে শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পেইন শুরু করে। রবিবার দুপুরে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে নাদিরা ইয়াসমিনকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানানো হয়৷ জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দেয় তারা। সোমবারই সক্রিয় হয়ে ওঠে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ প্রথমে ওএসডি, তারপর নাদিরাকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে বদলি করে দেয় মন্ত্রণালয়।

কোনো লেখায় নারীর হিস্যা দাবি করলে ধর্ম অবমাননা হয় কিনা জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের নরসিংদী জেলা শাখার মহাসচিব মাওলানা ইসমাইল হোসেন নূরপুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” নারী-পুরুষের সমান হিস্যার’ কথা বলা   পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধে যায়। কোরআনে সম্পত্তির সমান ভাগের কথা নাই। ছেলে যা পাবে, মেয়ে পাবে তার অর্ধেক।”

মানুষ তার অধিকারের কথা বা অধিকারের বিষয়ে নিজস্ব মতামত জানালে কীভাবে ধর্ম অবমাননা হয়- এমন প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, “এদেশে আরো যারা এইরকম কথা বলছে, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা অবস্থান নেবো। নারী সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধেও সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

‘অধিকারের কথা বলা কি অপরাধ?’

তবে নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোশতাক আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” নাদিরা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেননি। আর আমরা তার কোনো আচরণ বা কাজ আপত্তিকর বলে মনে করছি না। তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করেছে। বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।” তবে নাদিরা ইয়াসমিন বলেন, ” আমি  অনেক দিন ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করায় একটি গোষ্ঠী আমার বিরুদ্ধে আগে থেকেই ক্ষিপ্ত ছিল। এবার আমার ওই লেখার পর তারা একমাস ধরে প্রচারণা চালিয়েছে। আমি পুলিশ প্রশাসনকে  জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা আগে থেকে উদ্যোগ নিলে এই অবস্থা হতো না।” প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে নাদিয়া আরো বলেন, ” আমি নিজে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু যাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি, তারাও আমার পক্ষে এবার দাঁড়ায়নি। আর বর্তমান সরকার আমাকে রক্ষা না করে আমার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিলো। এটা আমার জন্য কষ্টের। আর এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, আরো অনেক নারীর ক্ষেত্রেই ঘটছে।”

“আমি এখন নরসিংদীতেই আছি। কিন্তু ভয়ের মধ্যে আছি। পাচ্ছি নানা হুমকি। নতুন কর্মস্থল সাক্ষীরায় যাওয়া আমার জন্য আরো বিপদের কারণ হতে পারে। শুনেছি, সেখানেও হেফাজতের লোকেরা আমাকে যোগ  দিতে দেবে না। তারা বলেছে, আমি কীভাবে ওই কলেজে যোগ দিই তা তারা দেখে নেবে। সরকার তো এখন আমাকে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করে দিলো। আমি তো আর কোথাও চাকরি করতে পারবো না,” বলেন তিনি।

নাদিরা ইয়াসমিনের প্রশ্ন, ” অধিকারের কথা বলা কি অপরাধ? আমি কি আমার কথা বলতে পারবো না?  সমান হিস্যার কথা বললে কীভাবে ধর্মের অবমাননা হয়? এটা বোঝাবার লোক কি দেশে নাই?”

বাংলাদেশে নারীদের ঝুঁকি বাড়ছে?

সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের ওপর আরো অনেক হামলা ও হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই হামলাকারী বা হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে তড়িৎ কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি ২২ মে-র৷ ঘটনাস্থল নিউমার্কেট সংলগ্ন চাঁদনী চক মার্কেট৷ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে দাম নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে চক মার্কেটের কয়েকজন দোকানদার হেনস্তা করে। অকথ্য ভাষায় গালাগালও করা হয় তাকে। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে গেলে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ পরে তিনজনকে আটক করে।

তার আগে ৬ মে কুড়িগ্রামের উলিপুরে গ্রাম্য সালিসে ‘অনৈতিক সম্পর্কের’  অপবাদ দিয়ে এক নারীর চুল কেটে নেয়া হয়। পুলিশের দাবি, তারা অভিযোগ পায়নি, পেলে ব্যবস্থা নেয়া হতো৷

এর আগে গত  ৯ মে সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জে লঞ্চঘাটে দুই তরুণীকে অশ্লীল পোশাক পরার কথা বলে কোমরের বেল্ট দিয়ে পেটায় কয়েকজন তরুণ। ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ এখন পর্যন্ত মাত্র  একজনকে আটক করেছে।

৫ মে কুষ্টিয়ায় শারমিন সুলতানা নামে এক নারী চিকিৎসককে একটি ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের সামনে রিকশা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। তার স্বামীও হামলা থেকে রেহাই পাননি। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হামলাকীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানবন্ধন করেন চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ। পরে পুলিশ হামলায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

৩ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করার দাবি ও প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কশিমনের নারী নেত্রীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা হয়।

১৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের সড়ক বাজারে জনসমক্ষে তিন নারীর মাথার চুল জোরপূর্বক কেটে দেয়ার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় ব্যবসায়ী সুমন দাসের বিরুদ্ধে। ওই দুই নারীকে প্লাস্টিকের পাইপ ও রড দিয়ে বেধড়ক মারধরের অভিযোগও পাওয়া যায়।

২ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় এক নারী সাংবাদিককে প্রকাশ্যে মারধর ও যৗন হয়রানি করা হয়। সেখানেও ভূমিকা ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের৷ মারধর ও যৌন হয়রানির দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ সক্রিয় হয়৷ একদিন পর চারজনকে আটক করা হয়।

২০ মার্চ কুড়িগ্রামের রৌমারিতে সরকারি রাস্তায় দেয়াল নির্মাণে বাধা দেয়া সাফিয়া বেগম নামে এক নারীকে প্রকাশ্যে মারপিট করে সৈয়দ জামাল ও তার ছেলে সাঈদুল হক। ওই নারী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর থানায় অভিযোগ করলেও আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে ওড়না ঠিক করতে বলার পাশাপাশি আরো কিছু ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করে আসিফ অর্ণব নামের এক তরুণ৷ অভিযোগ জানালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী অর্নবকে আটক করে পুলিশ৷ কিন্তু আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর রাতে ‘তৌহিদী জনতার’র ব্যানারে কিছু লোক শাহবাগ থানা ঘেরাও করে৷ রাতভর অর্ণবকে সমর্থন জানিয়ে থানা থেকে ফেসবুক লাইভও করে তারা৷ পরের দিন আদালত তাকে জামিন দিলে তৌহিদী জনতা তাকে ফুলের মালা আর পাগড়ি দিয়ে বরণ করে নেয়। পরে ওই ছাত্রী মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।

২ মার্চ ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি চায়ের দোকানে দুই তরুণী ধূমপান করায় কথাকাটি হলে কিছু লোক মব তৈরি করে তাদের হেনস্তা করে। কিন্তু হেনস্তাকরীদের আটক না করে ওই দুই তরুণীকে থানা হেফাজতে নিয়ে যায় পুলিশ। তারপর  স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন,” পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। কেউ যেন ওপেন প্লেসে ধূমপান না করেন।”

গত ২২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার লাহারকান্দি এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে দুই নারীকে প্রকাশ্যে মারধর করে মোহাম্মদ রাশেদ আলম নামে এক ব্যক্তি। সেই দৃশ্য ভিডিও করা হয় এবং পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দুই নারীকে শক্ত লাঠি দিয়ে পেটানোয় হাসলপাতালে ভর্তি হন৷ তাকে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ তৎপর হয়। কিন্তু পুলিশ কাজ শুরু করার আগেই ওই নির্যাতনকারীরা গাঢাকা  দেয়।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই নারীকে হয়রানি ও মরধর  করা হয়। পোশাক ‘খারাপ’ বলে একদল যুবক তাদের মারধর করে। পরে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তারপর পুলিশ মো. ফারুকুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী,  চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল- এই চার মাসে ৩৪২ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদর মধ্যে ৮৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তিনজনকে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়। আর চারজন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ওই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৯৯ জন। দুইজন যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছেন।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ‑পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় এক জনকে। ২০২৪ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ জন নারী। এ ছাড়া উত্ত্যক্ত আত্মহত্যা করেছে ২ জন ও খুন হয়েছে ৩ জন নারী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারের নীরবতার কারণে নারীরা এখন আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সরকার কয়েকটি ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও বাস্তবে কিছু করেনি। হেফাজতের সমাবেশে নারীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা হলো, ঔদ্ধত্বপূর্ণ কথা বলা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা , একটা বিবৃতিও দেয়া হয়নি।”

তার কথা ,” নরসিংদীর নাদিরা ইয়ামীন নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলেছেন। এটা তো আমাদের সংবিধানেই আছে। যারা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়ার কথা ছিল। তারা তো মব তৈরি করেছে। কিন্তু উল্টো ওই  নারী শিক্ষককে বদলি করে দেয়া হলো। এখন উগ্রবাদীরা তাকে আরো হেনস্তা করবে। সরকারই তার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ওই নারীকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলো। যেখানে রাষ্ট্রের কাজ ছিল তাকে নিরাপত্তা দেয়া। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এখন অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা, সহিংসতা আরো বাড়ছে।”

তিনি জানান,  মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়ে নাদিরা ইয়াসমীনের বদলির আদেশ প্রত্যাহার ও তাকে যারা হুমকি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার দাবি করা হয়েছে৷

নারীনিপীড়ন রোধে সরকারের ভূমিকা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারের যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারছে না, নারীবান্ধব হয়ে উঠতে পারছে না, নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না- নরসিংদীর কলেজ শিক্ষিকার ঘটনা তার প্রমাণ।”

তার কথা, ” নাদিরা ইয়ামিন এখানে সর্বশেষ উদাহরণ । কিন্তু এই সরকারের সময়ে আরো অনেক নারী নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন, আক্রমণের শিকার হয়েছেন- তাদের কারো ব্যাপারেই সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমার মনে হয়েছে, এই সরকার কট্টরপন্থিদের হাতে রাখতে চায়। তাদের ওপর কট্টরপন্থিদের প্রভাব আছে। এটা জুলাই আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থি।”

“কোনো একটি পক্ষ হুঙ্কার দিলেই সরকার দাবি মেনে নেবে? নাদিরা ইয়াসমিনের পক্ষেও তো অনেকে কথা বলছেন। অনেকে বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের কথা তো সরকার শুনছে না. শুনছে কট্টরপন্থিদের কথা। এ থেকেই বোঝা যায় সরকার তাদের প্রতি দুর্বল। আর এই কারণে নারীরা আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন,” বলেন তিনি।

১৪৭ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি

নাদিরা ইয়াসমীনের পক্ষে এরইমধ্যে ১৪৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে তাকে যারা হুমকি দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া ফেসবুকে নাদিয়ার পক্ষে স্ট্যাটাস দিয়েছেন অনেকেই। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন,” নরসিংদীর ঘটনায় সরকার ভিকটিমকে আরো ভিকটিমাইজ করলো। এতে মব সন্ত্রাস আরো উৎসাহিত হবে। যেখানে তাকে সুরক্ষা দেয়ার দরকার ছিল, সেখানে নাদিরাকে সাতক্ষীরায় বদলি করা হলো। সেখানে তাকে নিরাপত্তা  দেবে কে? এটা বাক স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা ও অধিারের প্রশ্ন।”

তার কথা,” বাংলাদেশে  আমরা লক্ষ্য করছি, নারীদের বিষয় এলে একটি মহল এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আর সরকার চুপ থাকছে। এর ফলে ওই গোষ্ঠী আরো উৎসাহিত হচ্ছে। নারীর মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা বা তাকে হেনস্তার বিরুদ্ধে সরকার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে মানুষের মনে ধারণা তৈরি হচ্ছে না যে, নারীদের  অধিকার খর্ব করা যাবে না।”

তবে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ দাবি করেন,” নারীর স্বাধীনতা, নারীর মুক্ত চিন্তা ও অধিকারের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। সরকার এরইমধ্যে নারীর ক্ষমতায়নসহ নারী উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। আর নারী বিষয়ক সংস্কার কশিনের প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনে প্রতিবেদন নিয়ে সব পক্ষ তাদের মতামত দেবে। তার ভিত্তিতে সুপারিশ চূড়ান্ত হবে।”

নরসিংদীর কলেজ শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,” ওখানে একদল মানুষ প্রতিবাদ করেছে। একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। তাই প্রথম কাজ হিসাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসাবে তিনি যেহেতু সরকারি চাকরি করেন, তাই তাকে বদলি করা হয়েছে। এখন তদন্ত হবে। সেই তদন্তে দেখা যাবে কে দোষী , কে দোষী নয়। সেইভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

ডিডাব্লিউ ডটকম

রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৭)

বাংলাদেশ : সমান হিস্যা চাওয়াও নারীর ‘অপরাধ’?

০৫:০৬:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

‘হিস্যা’ নামের ম্যাগাজিনের এক প্রবন্ধে নারী-পুরুষের সমান হিস্যার কথা লিখেছিলেন নাদিরা ইয়াসমিন৷ তাতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ও চাকরিচ্যুত করার দাবিতে মিছিল৷

সমান অধিকার দাবি করে নাদিরা ইয়াসমিন এখন বিপদে৷ হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে নরসিংদী সরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক নাদিরাকে ওএসডি করে বদলি করা হয়েছে৷ সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে যেতে হবে তাকে৷ রাতারাতি বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে বড় বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি৷

হেফাজতে ইসলামী ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, সাতক্ষীরা কলেজেও নাদিরা ইসলামকে যোগ দিতে দেয়া হবে না।হেফাজতের নরসিংদী জেলা শাখার মহাসচিব মাওলানা ইসমাইল হোসেন নূরপুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “শুধু বদলি করলে তো হবে না। আমরা তাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়ার দাবি করেছি। তাকে আরো বড় শাস্তি দিতে হবে।”

নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, নাদিরা ইয়াসমিনের শাস্তি যারা চেয়েছেন, তাদেরই শাস্তি হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু তাদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো নাদিরাকে শাস্তি দিয়েছে সরকার। তারা মনে করেন,

সরকারের এই অবস্থান উগ্রবাদীদের আরো বেপরোয়া করবে, কলেজ শিক্ষিকা নাদিরা হয়ত আরো বড় হুমকির মুখে পড়বেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উগ্রবাদীদের পক্ষাবলম্বন করছে বলেও মনে করেন তারা, কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে  হেফাজতের সমাবেশে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও  নারীদের নিয়ে অশ্লীল ভাষায় কথা সত্ত্বেও

সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি, এমন অশালীন আচরণের প্রতিবাদে কোনো বিবৃতিও দেয়নি।

নরসিংদীতে শিক্ষিকা নাদিরা যা করেছিলেন

নরসিংদী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের  সহকারি অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিন প্রায় ১১ বছর ধরে ওই কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তার বাড়িও নরসিংদীতে। নারী অধিকার কর্মী হিসাবেও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তিনি। ‘নারী অঙ্গন’ নামের একটি সংগঠন পরিচালনা করেন। ওই নামে একটি ওয়েব পোর্টালও আছে।  মাস  খানেক আগে ‘হিস্যা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে নারী অধিকার নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। কী লিখেছিলেন সেখানে? নাদিরা ইয়াসমিন এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” সেখানে আমি নারী-পুরুষের সমান হিস্যার কথা বলেছি। এটাই আমার অপরাধ।” ওই  লেখার পর স্থানীয় উগ্রবাদীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননা অভিযোগ তুলে শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পেইন শুরু করে। রবিবার দুপুরে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে নাদিরা ইয়াসমিনকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানানো হয়৷ জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দেয় তারা। সোমবারই সক্রিয় হয়ে ওঠে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ প্রথমে ওএসডি, তারপর নাদিরাকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে বদলি করে দেয় মন্ত্রণালয়।

কোনো লেখায় নারীর হিস্যা দাবি করলে ধর্ম অবমাননা হয় কিনা জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের নরসিংদী জেলা শাখার মহাসচিব মাওলানা ইসমাইল হোসেন নূরপুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” নারী-পুরুষের সমান হিস্যার’ কথা বলা   পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধে যায়। কোরআনে সম্পত্তির সমান ভাগের কথা নাই। ছেলে যা পাবে, মেয়ে পাবে তার অর্ধেক।”

মানুষ তার অধিকারের কথা বা অধিকারের বিষয়ে নিজস্ব মতামত জানালে কীভাবে ধর্ম অবমাননা হয়- এমন প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, “এদেশে আরো যারা এইরকম কথা বলছে, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা অবস্থান নেবো। নারী সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধেও সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

‘অধিকারের কথা বলা কি অপরাধ?’

তবে নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোশতাক আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” নাদিরা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেননি। আর আমরা তার কোনো আচরণ বা কাজ আপত্তিকর বলে মনে করছি না। তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করেছে। বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।” তবে নাদিরা ইয়াসমিন বলেন, ” আমি  অনেক দিন ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করায় একটি গোষ্ঠী আমার বিরুদ্ধে আগে থেকেই ক্ষিপ্ত ছিল। এবার আমার ওই লেখার পর তারা একমাস ধরে প্রচারণা চালিয়েছে। আমি পুলিশ প্রশাসনকে  জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা আগে থেকে উদ্যোগ নিলে এই অবস্থা হতো না।” প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে নাদিয়া আরো বলেন, ” আমি নিজে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু যাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি, তারাও আমার পক্ষে এবার দাঁড়ায়নি। আর বর্তমান সরকার আমাকে রক্ষা না করে আমার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিলো। এটা আমার জন্য কষ্টের। আর এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, আরো অনেক নারীর ক্ষেত্রেই ঘটছে।”

“আমি এখন নরসিংদীতেই আছি। কিন্তু ভয়ের মধ্যে আছি। পাচ্ছি নানা হুমকি। নতুন কর্মস্থল সাক্ষীরায় যাওয়া আমার জন্য আরো বিপদের কারণ হতে পারে। শুনেছি, সেখানেও হেফাজতের লোকেরা আমাকে যোগ  দিতে দেবে না। তারা বলেছে, আমি কীভাবে ওই কলেজে যোগ দিই তা তারা দেখে নেবে। সরকার তো এখন আমাকে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করে দিলো। আমি তো আর কোথাও চাকরি করতে পারবো না,” বলেন তিনি।

নাদিরা ইয়াসমিনের প্রশ্ন, ” অধিকারের কথা বলা কি অপরাধ? আমি কি আমার কথা বলতে পারবো না?  সমান হিস্যার কথা বললে কীভাবে ধর্মের অবমাননা হয়? এটা বোঝাবার লোক কি দেশে নাই?”

বাংলাদেশে নারীদের ঝুঁকি বাড়ছে?

সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের ওপর আরো অনেক হামলা ও হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই হামলাকারী বা হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে তড়িৎ কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি ২২ মে-র৷ ঘটনাস্থল নিউমার্কেট সংলগ্ন চাঁদনী চক মার্কেট৷ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে দাম নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে চক মার্কেটের কয়েকজন দোকানদার হেনস্তা করে। অকথ্য ভাষায় গালাগালও করা হয় তাকে। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে গেলে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ পরে তিনজনকে আটক করে।

তার আগে ৬ মে কুড়িগ্রামের উলিপুরে গ্রাম্য সালিসে ‘অনৈতিক সম্পর্কের’  অপবাদ দিয়ে এক নারীর চুল কেটে নেয়া হয়। পুলিশের দাবি, তারা অভিযোগ পায়নি, পেলে ব্যবস্থা নেয়া হতো৷

এর আগে গত  ৯ মে সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জে লঞ্চঘাটে দুই তরুণীকে অশ্লীল পোশাক পরার কথা বলে কোমরের বেল্ট দিয়ে পেটায় কয়েকজন তরুণ। ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ এখন পর্যন্ত মাত্র  একজনকে আটক করেছে।

৫ মে কুষ্টিয়ায় শারমিন সুলতানা নামে এক নারী চিকিৎসককে একটি ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের সামনে রিকশা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। তার স্বামীও হামলা থেকে রেহাই পাননি। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হামলাকীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানবন্ধন করেন চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ। পরে পুলিশ হামলায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

৩ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করার দাবি ও প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কশিমনের নারী নেত্রীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা হয়।

১৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের সড়ক বাজারে জনসমক্ষে তিন নারীর মাথার চুল জোরপূর্বক কেটে দেয়ার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় ব্যবসায়ী সুমন দাসের বিরুদ্ধে। ওই দুই নারীকে প্লাস্টিকের পাইপ ও রড দিয়ে বেধড়ক মারধরের অভিযোগও পাওয়া যায়।

২ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় এক নারী সাংবাদিককে প্রকাশ্যে মারধর ও যৗন হয়রানি করা হয়। সেখানেও ভূমিকা ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের৷ মারধর ও যৌন হয়রানির দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ সক্রিয় হয়৷ একদিন পর চারজনকে আটক করা হয়।

২০ মার্চ কুড়িগ্রামের রৌমারিতে সরকারি রাস্তায় দেয়াল নির্মাণে বাধা দেয়া সাফিয়া বেগম নামে এক নারীকে প্রকাশ্যে মারপিট করে সৈয়দ জামাল ও তার ছেলে সাঈদুল হক। ওই নারী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর থানায় অভিযোগ করলেও আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে ওড়না ঠিক করতে বলার পাশাপাশি আরো কিছু ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করে আসিফ অর্ণব নামের এক তরুণ৷ অভিযোগ জানালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী অর্নবকে আটক করে পুলিশ৷ কিন্তু আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর রাতে ‘তৌহিদী জনতার’র ব্যানারে কিছু লোক শাহবাগ থানা ঘেরাও করে৷ রাতভর অর্ণবকে সমর্থন জানিয়ে থানা থেকে ফেসবুক লাইভও করে তারা৷ পরের দিন আদালত তাকে জামিন দিলে তৌহিদী জনতা তাকে ফুলের মালা আর পাগড়ি দিয়ে বরণ করে নেয়। পরে ওই ছাত্রী মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।

২ মার্চ ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি চায়ের দোকানে দুই তরুণী ধূমপান করায় কথাকাটি হলে কিছু লোক মব তৈরি করে তাদের হেনস্তা করে। কিন্তু হেনস্তাকরীদের আটক না করে ওই দুই তরুণীকে থানা হেফাজতে নিয়ে যায় পুলিশ। তারপর  স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন,” পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। কেউ যেন ওপেন প্লেসে ধূমপান না করেন।”

গত ২২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার লাহারকান্দি এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে দুই নারীকে প্রকাশ্যে মারধর করে মোহাম্মদ রাশেদ আলম নামে এক ব্যক্তি। সেই দৃশ্য ভিডিও করা হয় এবং পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দুই নারীকে শক্ত লাঠি দিয়ে পেটানোয় হাসলপাতালে ভর্তি হন৷ তাকে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ তৎপর হয়। কিন্তু পুলিশ কাজ শুরু করার আগেই ওই নির্যাতনকারীরা গাঢাকা  দেয়।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই নারীকে হয়রানি ও মরধর  করা হয়। পোশাক ‘খারাপ’ বলে একদল যুবক তাদের মারধর করে। পরে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তারপর পুলিশ মো. ফারুকুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী,  চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল- এই চার মাসে ৩৪২ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদর মধ্যে ৮৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তিনজনকে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়। আর চারজন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ওই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৯৯ জন। দুইজন যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছেন।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ‑পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় এক জনকে। ২০২৪ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ জন নারী। এ ছাড়া উত্ত্যক্ত আত্মহত্যা করেছে ২ জন ও খুন হয়েছে ৩ জন নারী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারের নীরবতার কারণে নারীরা এখন আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সরকার কয়েকটি ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও বাস্তবে কিছু করেনি। হেফাজতের সমাবেশে নারীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা হলো, ঔদ্ধত্বপূর্ণ কথা বলা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা , একটা বিবৃতিও দেয়া হয়নি।”

তার কথা ,” নরসিংদীর নাদিরা ইয়ামীন নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলেছেন। এটা তো আমাদের সংবিধানেই আছে। যারা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়ার কথা ছিল। তারা তো মব তৈরি করেছে। কিন্তু উল্টো ওই  নারী শিক্ষককে বদলি করে দেয়া হলো। এখন উগ্রবাদীরা তাকে আরো হেনস্তা করবে। সরকারই তার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ওই নারীকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলো। যেখানে রাষ্ট্রের কাজ ছিল তাকে নিরাপত্তা দেয়া। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এখন অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা, সহিংসতা আরো বাড়ছে।”

তিনি জানান,  মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়ে নাদিরা ইয়াসমীনের বদলির আদেশ প্রত্যাহার ও তাকে যারা হুমকি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার দাবি করা হয়েছে৷

নারীনিপীড়ন রোধে সরকারের ভূমিকা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারের যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারছে না, নারীবান্ধব হয়ে উঠতে পারছে না, নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না- নরসিংদীর কলেজ শিক্ষিকার ঘটনা তার প্রমাণ।”

তার কথা, ” নাদিরা ইয়ামিন এখানে সর্বশেষ উদাহরণ । কিন্তু এই সরকারের সময়ে আরো অনেক নারী নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন, আক্রমণের শিকার হয়েছেন- তাদের কারো ব্যাপারেই সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমার মনে হয়েছে, এই সরকার কট্টরপন্থিদের হাতে রাখতে চায়। তাদের ওপর কট্টরপন্থিদের প্রভাব আছে। এটা জুলাই আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থি।”

“কোনো একটি পক্ষ হুঙ্কার দিলেই সরকার দাবি মেনে নেবে? নাদিরা ইয়াসমিনের পক্ষেও তো অনেকে কথা বলছেন। অনেকে বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের কথা তো সরকার শুনছে না. শুনছে কট্টরপন্থিদের কথা। এ থেকেই বোঝা যায় সরকার তাদের প্রতি দুর্বল। আর এই কারণে নারীরা আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন,” বলেন তিনি।

১৪৭ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি

নাদিরা ইয়াসমীনের পক্ষে এরইমধ্যে ১৪৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে তাকে যারা হুমকি দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া ফেসবুকে নাদিয়ার পক্ষে স্ট্যাটাস দিয়েছেন অনেকেই। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন,” নরসিংদীর ঘটনায় সরকার ভিকটিমকে আরো ভিকটিমাইজ করলো। এতে মব সন্ত্রাস আরো উৎসাহিত হবে। যেখানে তাকে সুরক্ষা দেয়ার দরকার ছিল, সেখানে নাদিরাকে সাতক্ষীরায় বদলি করা হলো। সেখানে তাকে নিরাপত্তা  দেবে কে? এটা বাক স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা ও অধিারের প্রশ্ন।”

তার কথা,” বাংলাদেশে  আমরা লক্ষ্য করছি, নারীদের বিষয় এলে একটি মহল এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আর সরকার চুপ থাকছে। এর ফলে ওই গোষ্ঠী আরো উৎসাহিত হচ্ছে। নারীর মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা বা তাকে হেনস্তার বিরুদ্ধে সরকার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে মানুষের মনে ধারণা তৈরি হচ্ছে না যে, নারীদের  অধিকার খর্ব করা যাবে না।”

তবে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ দাবি করেন,” নারীর স্বাধীনতা, নারীর মুক্ত চিন্তা ও অধিকারের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। সরকার এরইমধ্যে নারীর ক্ষমতায়নসহ নারী উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। আর নারী বিষয়ক সংস্কার কশিনের প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনে প্রতিবেদন নিয়ে সব পক্ষ তাদের মতামত দেবে। তার ভিত্তিতে সুপারিশ চূড়ান্ত হবে।”

নরসিংদীর কলেজ শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,” ওখানে একদল মানুষ প্রতিবাদ করেছে। একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। তাই প্রথম কাজ হিসাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসাবে তিনি যেহেতু সরকারি চাকরি করেন, তাই তাকে বদলি করা হয়েছে। এখন তদন্ত হবে। সেই তদন্তে দেখা যাবে কে দোষী , কে দোষী নয়। সেইভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

ডিডাব্লিউ ডটকম