২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্কনীতি আরও কঠোর করে তুলেছেন। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিকে সামনে রেখে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত এই খাতটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচিত।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে রক্ষা এবং আমদানি নির্ভরতা কমানোর যুক্তিতে ট্রাম্প প্রশাসন নতুন করে বিভিন্ন দেশের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ঘোষিত নতুন নীতিতে বাংলাদেশের চামড়া, চামড়ার তৈরি জুতা, ব্যাগ ও আনুষঙ্গিক পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
আগে এসব পণ্যে গড়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ শুল্ক ছিল, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশে। এই পরিবর্তন রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প এখনো প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং মূল্য সংযোজনের দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে। দেশের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র সাভারের ট্যানারিগুলো এখনো পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ। তারপরও সস্তা শ্রম ও কাঁচামালের সহজলভ্যতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ২০২৪ সালে মোট রপ্তানির প্রায় ২২ শতাংশই ছিল আমেরিকামুখী।
শুল্ক বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব
মূল্য প্রতিযোগিতায় ধাক্কা:
নতুন শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। একই ধরনের চীনা, ভারতীয় কিংবা ভিয়েতনামি পণ্য তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
রপ্তানি হ্রাস:
বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য তৈরি জুতা ও ব্যাগের বাজারে, যেখানে দামের প্রভাব বেশি, সেখানে বাংলাদেশি রপ্তানি হ্রাস পাবে। এতে বিকল্প বাজার খোঁজার চাপ বাড়বে।
কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাই:
রপ্তানি কমে গেলে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো আর্থিক সংকটে পড়বে, যার ফলে হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সরাসরি ৩০ হাজার এবং পরোক্ষভাবে আরও ৫০ হাজার শ্রমিক এই সংকটে আক্রান্ত হতে পারেন।
আমেরিকান বাজারে ভবিষ্যৎ প্রবণতা
যুক্তরাষ্ট্রে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা এখনো স্থিতিশীল। তবে অতিরিক্ত শুল্কের ফলে আমদানিকারকরা মেক্সিকো, ব্রাজিল, ভারত বা ইথিওপিয়ার মতো দেশের দিকে ঝুঁকতে পারে, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সুবিধা আছে।
বাংলাদেশ যদি পণ্যের মান উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে কেবল শুল্ক নয়, বরং নন-ট্যারিফ বাধার মুখেও পড়তে হতে পারে।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য কৌশল
নতুন বাজার অনুসন্ধান:
চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশকে এই বাজারগুলোতে প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে।
মান উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহার:
কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব, প্রযুক্তিনির্ভর এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের দিকে যেতে হবে, যাতে উচ্চমূল্যের বাজার ধরতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি:
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক হ্রাস বা পুরোনো বাণিজ্য সুবিধা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
রপ্তানি প্রণোদনা:
শুল্কজনিত ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নগদ সহায়তা, করছাড় বা ভর্তুকি বাড়াতে পারে, যাতে রপ্তানিকারকরা ক্ষতিপূরণ পায়।
নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের জন্য একটি গুরুতর সংকেত। এটি কেবল বৈদেশিক মুদ্রা আয়েই নয়, বরং শিল্পনির্ভর শ্রমজীবীদের জীবন ও জীবিকাতেও বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তাই বহুমাত্রিক বাজার অনুসন্ধান, পণ্যের মানোন্নয়ন এবং জোরালো কূটনীতিই হতে পারে এই সংকট মোকাবেলার মূল অস্ত্র। দেশের শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি।