পাকিস্তানের ইসলামাবাদের কাছে তারনোল এলাকায় একটি অবৈধ গাধা জবাই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৫০টিরও বেশি গাধা উদ্ধার করেছে ইসলামাবাদ ফুড অথরিটি (আইএফএ)। অভিযানে এক টন (প্রায় ২৫ মণ) গাধার মাংস জব্দ করা হয়েছে, যা বিতরণের জন্য প্রস্তুত ছিল। স্থানীয় পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় পরিচালিত এই অভিযানে এক বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যিনি এই আন্তর্জাতিক অবৈধ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
আইএফএ’র উপপরিচালক ডা. তাহিরা সিদ্দিক জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এই মাংস শুধু স্থানীয়ভাবে বিক্রির জন্য নয়, বরং বিদেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যেও প্রস্তুত করা হচ্ছিল। স্বাস্থ্যবিধি ও রপ্তানি নীতিমালা লঙ্ঘন করেই এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। জব্দ করা সব মাংস ঘটনাস্থলেই ধ্বংস করা হয়েছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
বিশ্বব্যাপী চীনা চাহিদা ও কালোবাজারের উত্থান
এই অবৈধ বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কারণ চীনে গাধার চামড়া ও মাংসের ব্যাপক চাহিদা। চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ‘ই-জিয়াও’, যা গাধার চামড়া থেকে তৈরি হয়। এটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ত্বক এবং প্রজনন স্বাস্থ্য উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়।
ই-জিয়াও-এর ইতিহাস তিন হাজার বছরের পুরোনো এবং এটি চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। শানডং প্রদেশ বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত ই-জিয়াও-এর প্রায় ৯০ শতাংশ জোগান দেয়। এই বিশাল চাহিদা পূরণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ গাধার চামড়া প্রয়োজন হয়, যা অনেক দেশেই অবৈধ জবাই কার্যক্রমকে উৎসাহিত করছে। পাকিস্তানও এই চক্রের বাইরে নয়।
কালোবাজার থেকে বৈধ রপ্তানি কাঠামোর দিকে যাত্রা
যদিও তারনোলের ঘটনাটি অবৈধতার দিকটি সামনে এনেছে, পাকিস্তান ইতোমধ্যে গাধার চামড়া রপ্তানির বৈধ পথে যাত্রা শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুনে পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা চীনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির আওতায় গাধার চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেয়, যেখানে দুগ্ধজাত পণ্য, গবাদিপশু ও কৃষিপণ্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চুক্তির পর চীনের ‘হ্যাংএং ট্রেড কোম্পানি’ গোয়াদরে ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগে পাকিস্তানের প্রথম সরকারি অনুমোদিত গাধার মাংস ও চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন করে। এই কেন্দ্রটি বছরে তিন লাখ গাধার চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম এবং চীনের প্রসাধনী ও ওষুধশিল্পে সরবরাহ করে। এখান থেকে গাধার মাংস ও হাড়ও রপ্তানি করা হবে।
এই বৈধ কাঠামো পাকিস্তানের জন্য একটি বিরল সুযোগ তৈরি করেছে—অর্থনীতি সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, ট্রেসযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বহুমুখী লাভ অর্জন সম্ভব।
দেশীয় বাজারে প্রভাব ও দরবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া
২০২৫ সালের জুনে পাকিস্তানে গাধার সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ ৪৭ হাজার, যা গত এক বছরে ১ লাখ ৯ হাজার বেড়েছে। তবে বৈদেশিক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে চামড়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, যার ফলে স্থানীয় শ্রম বাজারে গাধা কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী পরিবহন ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত গাধাগুলো এখন বেশি দামে রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে গাধা ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, স্থানীয় চাহিদা কমে গেছে এবং বর্তমানে বেশিরভাগ গাধা মূলত রপ্তানির উদ্দেশ্যেই কেনাবেচা হচ্ছে। এই দরবৃদ্ধি রপ্তানিকারক ও প্রজননকারীদের লাভবান করলেও স্থানীয় ব্যবহারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং প্রাণী অধিকার ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি
ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞ ও প্রাণী অধিকারকর্মীরা অবিলম্বে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, এসব অবৈধ কসাইখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাধা জবাই করা হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে। এই মাংসে রোগজীবাণু থাকতে পারে, যা মানুষের জীবনের জন্য বিপজ্জনক।
একজন খাদ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “এটি শুধু প্রতারণা নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের বিষয়। ভুলভাবে লেবেলযুক্ত বা দূষিত গাধার মাংস খাওয়া হলে মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।”
এজন্য আইএফএ নাগরিকদের সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে এবং কোথাও সন্দেহজনকভাবে জবাই বা লেবেল ছাড়াই মাংস বিক্রির ঘটনা দেখতে পেলে রিপোর্ট করার আহ্বান জানিয়েছে।
দ্বৈত বাস্তবতা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দোলাচল
এই অভিযান পাকিস্তানের এক জটিল বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একদিকে, বৈধভাবে রপ্তানির সুযোগ নতুন বৈদেশিক আয় ও কর্মসংস্থানের পথ খুলে দিতে পারে; অন্যদিকে, অবৈধ কার্যক্রম জনস্বাস্থ্য, প্রাণীর অধিকার এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।
ডা. তাহিরা সিদ্দিক বলেন, “এই অভিযান একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—পাকিস্তান দায়িত্বশীল বাণিজ্যে বিশ্বাস করে, তবে অবৈধ কার্যক্রম কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।”
গাধার মাংস ও চামড়া নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিশেষ করে চীনের মতো দেশের চাহিদা অনুযায়ী, পাকিস্তানের সামনে সম্ভাবনা এবং সংকট—দু’টি দিকই তৈরি করেছে। এখন জরুরি হলো, সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি সুশৃঙ্খল, নৈতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত বাণিজ্য কাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে কৃষিজীবী, রপ্তানিকারক এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থ একসাথে সুরক্ষিত থাকবে।