প্রতিদিনের শুরু চাঁদা দিয়ে
গুলিস্তানের ফুটপাতে শিশুদের পোশাক বিক্রি করেন এনামুল হক। সকালবেলা দোকান বসানোর আগেই তাঁকে ছাত্রদের সংগঠন এবং বড় দলের নেতাকর্মীদের কাছে প্রতিদিন মোট তিন শত টাকা চাঁদা দিতে হয়—দুই পক্ষকেই একশ পঞ্চাশ টাকা করে। এ টাকার অঙ্কটি শুনতে কম মনে হলেও মাসে তা দাঁড়ায় নয় হাজার টাকা। আর বছরের হিসাবে প্রায় এক লাখ আট হাজার টাকা। এই টাকা তাঁকে দিতে হয় তাঁর দৈনিক বিক্রির অনেকটা অংশ কেটে।
এনামুল বলেন, ‘দিনে গড় আয় হয় হাজার থেকে বারো শত টাকা। তার মধ্যে তিন শত টাকা দিয়েই চলে যায় চাঁদায়। এরপর দোকান ভাড়া, মালামাল কিনে রাখা, বাড়ির খরচ—সব মিলিয়ে হাতে কিছুই থাকে না।’
নিউ মার্কেটের মমিনার আত্মকথন
নিউ মার্কেটের এক কোণায় মহিলাদের থ্রি-পিস ও শিশুদের জামা বিক্রি করেন মমিনা খাতুন। তাঁর কাছে প্রতিদিন এসে হাজির হয় স্থানীয় এক ছাত্রনেতার প্রতিনিধি। কেউ আবার বলে, ‘আপা, এলাকার উন্নয়ন ফান্ডে একটু সহযোগিতা করুন।’ কেউ কেউ সরাসরিই বলে, ‘বসার জায়গা তো আমাদের কারণে পাচ্ছেন, একটু খরচ করতেই হবে।’
মমিনা বলেন, ‘প্রতিদিন দুই শত টাকা করে দিই। কাউকে দিতে না চাইলে বাক্স উল্টে ফেলে, দোকান তুলে দেয়। এখন তো পুলিশের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাই না।’
মিরপুরের করিমের ক্ষয়ের হিসাব
মিরপুর ১ নম্বরে দাঁড়িয়ে কাপড় বিক্রি করেন করিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করি। আগে প্রতিদিন এক শত টাকা দিতাম। এখন তিন জন ভাগে নেয়—সমন্বয়ক, ছাত্রদল আর স্থানীয় মস্তান। এক একজন এক শত টাকা করে নেয়। মোট তিন শত টাকা দিতে হয় প্রতিদিন।’
করিমের হিসাবে, মাসে তাঁর চাঁদা দাঁড়ায় নয় হাজার টাকা। বছরে এক লাখ আট হাজার টাকা। অথচ তাঁর মূলধন ছিল মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা। তার প্রায় অর্ধেকই এখন ঋণে চলছে।
তিনি বলেন, ‘জানি না আর কত দিন টিকতে পারব। যদি হঠাৎ অসুস্থ হই বা মাল বিক্রি কমে যায়, তাহলে দোকানই বন্ধ হয়ে যাবে।’
ফার্মগেটের শামীমের যুদ্ধ
ফার্মগেট মোড়ে রঙিন জামা ও ওড়না সাজিয়ে বসে আছেন শামীম হোসেন। প্রতিদিন প্রায় তিন শত টাকা গচ্ছা দিতে হয় ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং বাজার কমিটির তথাকথিত ‘শান্তি রক্ষা বাহিনী’-কে।
শামীম বলেন, ‘চাঁদা না দিলে দোকান ভেঙে ফেলে। পুলিশ বললে বলে, “ওরা তো নিজেরা খায়, আমরা কী করব?” কেউ কেউ বলে, “তুমিই তো অবৈধভাবে বসে আছো।” অথচ আমি এক ইঞ্চি রাস্তা দখল করিনি, ফুটপাতের বাইরে বসি।’
চাঁদার চাপ: ভবিষ্যতের আশঙ্কা
এই চারটি পরিবারই দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে ঋণ ও ক্ষতির চক্রে। যারা প্রতিদিন এক হাজার টাকা আয় করে, তাদের জন্য তিন শত টাকা চাঁদা মানে শতকরা তিরিশ ভাগ ক্ষতি। ফলে তাদের হাতে যা থাকে, তা দিয়ে পরিবারের খরচ, বাসা ভাড়া, সন্তানদের পড়াশোনা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
শুধু আর্থিক দিক নয়, মানসিক চাপও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত কে কখন দোকানে এসে চাঁদা দাবি করবে, কে উল্টো অভিযোগে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে—এই আতঙ্কে দিন কাটে তাদের।
বন্ধ হয়ে যেতে পারে ব্যবসা
যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে খুব শিগগিরই এই পরিবারগুলো তাদের ব্যবসা চালাতে পারবে না।
- প্রথমত,মূলধন শেষ হয়ে যাবে।
- দ্বিতীয়ত,ঋণ বেড়ে যাবে।
- তৃতীয়ত,নতুন পণ্য কেনার সামর্থ্য থাকবে না।
- চতুর্থত,কেউ কেউ হয়তো অসুস্থ হবে, অথবা কেউ কাজ করতে পারবে না—তখন কোনো বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এই পরিবারগুলো দ্রুত দারিদ্র্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাবে।
শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহীতেও একইভাবে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় এর প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি বদলায়নি।