১২:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
সোনালি যুগের সাময়িকী পাকিস্তান আবার গাধা নিয়ে সংকটে পাকিস্তানি খেলোয়াড় নিখোঁজ রহস্য ও ক্রীড়া ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি ট্রাম্পের যুগে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও বিভ্রান্ত—কীভাবে আমেরিকান কৌতুককারীরা হেরে যাচ্ছেন? পুরান ঢাকার শামবাজার: ইতিহাস, উত্থান-পতন ও বর্তমান অবস্থা রংপুরের গংগাচড়ায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, কী জানা যাচ্ছে “শান্তিচুক্তি, শুল্ক ও জিম্মিমুক্তি: ট্রাম্প কূটনীতির মুখপাত্র রুবিওর বার্তা” রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৭) মৃত্যুর মিছিল থামছেই না: সাভারে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ দম্পতি ব্ল্যাকপিংকের ‘জাম্প’ গানে বড় ধরনের হ্যাকিং, একাধিক প্ল্যাটফর্মে বিশৃঙ্খলা

হাসান ইমাম: মঞ্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ—এক সংগ্রামী শিল্পীর অভিযাত্রা

হাসান ইমাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ২৯ জুলাই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। দেশভাগের পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। শিক্ষাজীবনে তিনি সাহিত্য, আবৃত্তি ও নাট্যচর্চায় সক্রিয় ছিলেন। এই আগ্রহই তাঁকে অভিনয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জগতে টেনে আনে।

অভিনয়জীবনের সূচনা

তাঁর অভিনয়জীবন শুরু হয় মঞ্চনাটকের মাধ্যমে। এরপর তিনি চলচ্চিত্রে যুক্ত হন এবং ১৯৬০-এর দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ একজন অভিনেতা হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পিচঢালা পথ’। এরপর তিনি ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সুতরাং’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘লালন’, ‘এদেশ তোমার আমার’সহ বহু স্মরণীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

বিশেষ করে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ছবিটিতে তিনি একজন রাজনৈতিক সচেতন নাগরিকের ভূমিকায় ছিলেন, যা তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব

১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির পরিচয় ও ভাষার পক্ষে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাতে হাসান ইমাম ছিলেন সম্মুখ সারির একজন। তিনি ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী যিনি মঞ্চনাটক, পথনাটক, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন।

ঢাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন নাট্যদল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং নেতৃত্বও দিয়েছেন। শিল্পীদের অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য গঠিত নানা আন্দোলনেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাসান ইমাম দেশত্যাগ করে কলকাতায় যান এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে সক্রিয় হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে জনমত গড়ে তুলতে নাটক, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে ভূমিকা রাখেন।

প্লেব্যাকে হাসান ইমামের অভিষেক!

তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠশিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর কণ্ঠে প্রচারিত গান, কবিতা ও বার্তাগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাহস জাগিয়েছিল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সাংগঠনিক নেতৃত্ব

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি আবারও মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্বে উঠে আসেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বোর্ড, বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপদেষ্টা পরিষদসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৮০-এর দশকে “বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ” গঠন করেন, যার মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেন।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহু সম্মাননা অর্জন করেন। তাঁর প্রাপ্ত প্রধান পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার।

ব্যক্তি হাসান ইমাম: এক দায়বদ্ধ শিল্পী

হাসান ইমাম শুধু একজন দক্ষ অভিনেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সামাজিকভাবে সচেতন ও দায়বদ্ধ বাঙালি। শিল্পকে তিনি কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি—বরং একে তিনি ব্যবহার করেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগানোর হাতিয়ার হিসেবে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই তিনি লড়াই করেছেন অন্যায়, অসত্য এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হাসান ইমামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি যেমন মঞ্চ ও পর্দায় চরিত্রের ভেতর দিয়ে দর্শকের হৃদয়ে পৌঁছেছেন, তেমনি সংগ্রামী শিল্পী হিসেবে জাতির মুক্তির সংগ্রামে রেখেছেন অপরিসীম অবদান। তাঁর জীবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে—একজন শিল্পী কিভাবে সমাজের বিবেক হয়ে উঠতে পারেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি।

সোনালি যুগের সাময়িকী

হাসান ইমাম: মঞ্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ—এক সংগ্রামী শিল্পীর অভিযাত্রা

০৬:২১:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫

হাসান ইমাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ২৯ জুলাই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। দেশভাগের পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। শিক্ষাজীবনে তিনি সাহিত্য, আবৃত্তি ও নাট্যচর্চায় সক্রিয় ছিলেন। এই আগ্রহই তাঁকে অভিনয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জগতে টেনে আনে।

অভিনয়জীবনের সূচনা

তাঁর অভিনয়জীবন শুরু হয় মঞ্চনাটকের মাধ্যমে। এরপর তিনি চলচ্চিত্রে যুক্ত হন এবং ১৯৬০-এর দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ একজন অভিনেতা হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পিচঢালা পথ’। এরপর তিনি ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সুতরাং’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘লালন’, ‘এদেশ তোমার আমার’সহ বহু স্মরণীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

বিশেষ করে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ছবিটিতে তিনি একজন রাজনৈতিক সচেতন নাগরিকের ভূমিকায় ছিলেন, যা তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব

১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির পরিচয় ও ভাষার পক্ষে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাতে হাসান ইমাম ছিলেন সম্মুখ সারির একজন। তিনি ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী যিনি মঞ্চনাটক, পথনাটক, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন।

ঢাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন নাট্যদল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং নেতৃত্বও দিয়েছেন। শিল্পীদের অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য গঠিত নানা আন্দোলনেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাসান ইমাম দেশত্যাগ করে কলকাতায় যান এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে সক্রিয় হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে জনমত গড়ে তুলতে নাটক, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে ভূমিকা রাখেন।

প্লেব্যাকে হাসান ইমামের অভিষেক!

তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠশিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর কণ্ঠে প্রচারিত গান, কবিতা ও বার্তাগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাহস জাগিয়েছিল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সাংগঠনিক নেতৃত্ব

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি আবারও মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্বে উঠে আসেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বোর্ড, বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপদেষ্টা পরিষদসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৮০-এর দশকে “বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ” গঠন করেন, যার মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেন।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহু সম্মাননা অর্জন করেন। তাঁর প্রাপ্ত প্রধান পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার।

ব্যক্তি হাসান ইমাম: এক দায়বদ্ধ শিল্পী

হাসান ইমাম শুধু একজন দক্ষ অভিনেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সামাজিকভাবে সচেতন ও দায়বদ্ধ বাঙালি। শিল্পকে তিনি কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি—বরং একে তিনি ব্যবহার করেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগানোর হাতিয়ার হিসেবে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই তিনি লড়াই করেছেন অন্যায়, অসত্য এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হাসান ইমামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি যেমন মঞ্চ ও পর্দায় চরিত্রের ভেতর দিয়ে দর্শকের হৃদয়ে পৌঁছেছেন, তেমনি সংগ্রামী শিল্পী হিসেবে জাতির মুক্তির সংগ্রামে রেখেছেন অপরিসীম অবদান। তাঁর জীবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে—একজন শিল্পী কিভাবে সমাজের বিবেক হয়ে উঠতে পারেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি।