খাদ্য পরিবেশকের ঘরে আজ না খেয়ে থাকার ভয়
পান্থপথের এক সময়কার জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট ‘ফ্লেভার ইন’-এ আগে ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই লেগে থাকত ব্যস্ততা। ঈদের ছুটির আগে মানুষ পরিবার নিয়ে আসত ভোজন করতে। সেই রেস্টুরেন্ট এখন তালাবদ্ধ। কাজ হারিয়েছেন ২২ জন কর্মী। তাদের একজন মো. রফিকুল ইসলাম (৩৮), আগে তিনি ছিলেন ‘হেড ওয়েটার’। বর্তমানে তিনি মোহাম্মদপুরে একটি ভাঙারি দোকানে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন।
“ঈদ আসছে, অথচ নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা শার্টও কিনতে পারিনি। আগে আমি লোকজনকে বিরিয়ানি পরিবেশন করতাম, এখন আমার নিজের বাসায় রান্নার চুলাটাই ঠান্ডা,”—বললেন রফিকুল, চোখে পানি টলমল করতে করতে।
“মানুষের খাওয়ার প্লেট সাজাতাম, এখন নিজের প্লেটই খালি”
পুরানা পল্টনের ‘নিউ সিটি ফুড কর্নার’-এ ১০ বছর ধরে কাজ করছিলেন মালেকা বেগম (৪২)। গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ মালিক দোকান বন্ধ করে দেয়। কোনো প্রভিশন, বকেয়া বেতন ছাড়াই তাকে জানানো হয়—“আর দরকার নেই আপনার।”
মালেকা বললেন, “ঈদে আগে রান্নাঘরে আমরা সবাই মিলে বিরিয়ানি, তেহারি করতাম। এখন নিজের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না—ঈদের দিন কী খেতে চায়।”
তিনি বর্তমানে বস্তিতে অন্যের বাসায় রান্নার কাজ করেন। দৈনিক ২০০–২৫০ টাকা মেলে, কিন্তু সেটা দিয়ে কোনো ঈদ হয় না।
শুধু রেস্টুরেন্ট নয়, বন্ধ খাবারের হোটেল, ক্যাফে, স্ট্রিট ফুড
করোনার পর থেকে শুরু হওয়া খাবারের ব্যবসার সংকট আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে—এইবার তা এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কর্মী সংকোচন, বিদ্যুৎবিভ্রাট ও দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফনের কারণে। ক্যাফেগুলোর কর্মীরা বেকার, স্ট্রিট ফুড ভেন্ডররাও বিক্রি কমে যাওয়ায় সহকারীদের ছাঁটাই করেছে।
মিরপুর-১ নম্বরে ‘হেলো ফুড’ নামে ছোট এক দোকানে কাজ করতেন জুয়েল। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে মার্চে। এখন তিনি রাস্তায় মোমবাতি বিক্রি করেন।
“ঈদে খুশির আলো আসে বলে শুনি। আমার ঘরে এখন শুধু মোমবাতির আলো, তাও বিক্রি করতে হয়,”—হাসি দিয়ে বললেন জুয়েল, কিন্তু হাসিটা যে ভেতরে কান্না, তা বোঝা যায়।
“ঈদ মানে বোনাস, এবার মানে চিন্তা”
রেস্টুরেন্ট কর্মীদের মধ্যে ঈদের আগে একটা সময় ছিল সবচেয়ে আনন্দের—তখন তারা বোনাস পেতেন, নতুন জামা কিনতেন, পরিবারে ফিরতেন। এখন সেই উৎসব নেই, নতুন জামা নেই, বরং ঘরে ফেরার সাহস নেই কারণ দিতে হবে প্রশ্নের উত্তর—“কী এনেছো?”
বংশালের শাহিন, যিনি একজন রাঁধুনি ছিলেন একটি কিচেন-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে, বলেন—“আমার স্ত্রী বলে, ঈদে বাড়ি এসো না, কিছু নিয়ে না এলে ছেলে মন খারাপ করবে।”
কোরবানি নয়, ‘খাবার জুটবে কি না’ সেটাই বড় প্রশ্ন
রেস্টুরেন্ট কর্মীদের বড় অংশই নিম্নআয়ের মানুষ, যারা প্রতিদিনের আয়ে বেঁচে থাকেন। ঈদে কোরবানি তো দূরের কথা, একবেলা মাংস খাওয়া নিয়ে এখন সংশয়। কেউ কেউ বলছেন, ঈদের দিনেও তারা হয়তো কাজের খোঁজে ঘুরবেন, যদি কেউ একবেলার জন্য ডেকে নেয়, কিছু খেতে দেয়।
সহায়তা নেই, সংগঠিত প্রয়াসও দুর্বল
এই খাতের কর্মীদের জন্য কোনো বিশেষ সহায়তা নেই। ফুড-সার্ভিস ইউনিয়নগুলোর কার্যকর নেটওয়ার্ক না থাকায় তারা সংগঠিতভাবে দাবি জানাতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, “একটা স্মার্ট সিটি গড়ার স্বপ্নে আমরা যাদের ওপর নির্ভর করি, সেই রাঁধুনিদের আজ অভুক্ত থাকতে হয়।”
প্রতীক্ষা একটা ‘অর্ডারের’, কিন্তু এইবার নিজের জন্য
এই ঈদে রেস্টুরেন্ট কর্মীদের কেউ কেউ হয়তো পুরনো সহকর্মীর বাসায় গিয়ে একবেলা খাবেন। কারও ঘরে কেউ আসবে না, কেউ দাওয়াত দেবে না। তবুও তারা আশা করছেন—একদিন আবার আগের মতো ব্যস্ততা ফিরবে, বেকারত্ব যাবে।
“কেউ যদি বলে—চলে এসো, রান্না করতে হবে ঈদের জন্য—আমি চোখ বুজে যাব। এখন একটা অর্ডারও জীবনের নতুন শুরু,”—বলছিলেন মালেকা।