১০:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের কবিতা কখন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথী হয়

বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কবিতা বরাবরই বিপ্লবী চেতনা, মানবিকতা এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমান সময়েও যখন বৈশ্বিক ও স্থানীয় সংকট, সামাজিক বৈষম্য, গণতন্ত্রের সংকোচন, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার ক্রমশ বাড়ছে, তখন কবিতা নতুন করে প্রগতিশীল আন্দোলনকে শক্তি ও ভাষা জোগাচ্ছে।

কবিতার ঐতিহাসিক প্রগতিশীল ভূমিকা

বাংলাদেশের কবিতার প্রগতিশীল ধারা নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক শাসন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে মুকুলিত এই ধারা কায়ক্লেশে লালিত হয়েছে। ঊনিশ ও বিশ শতকের শুরুতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ এবং ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন:

তাঁর বিদ্রোহী কবিতা বা সাম্যবাদী আহ্বান ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল।

একইভাবে, ভাষা আন্দোলনের সময় আবদুল গাফফার চৌধুরীর “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” অথবা শামসুর রাহমানের “ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯” কবিতা জনমনে বিপ্লবী স্পৃহা ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শামসুর রাহমানের “স্বাধীনতা তুমি” বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের বোমার ছেলেকে উৎসর্গ করা কবিতা আমাদের প্রতিরোধ এবং স্বপ্নকে ভাষা দিয়েছিল।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রগতিশীল কবিতা

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি:
রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সংকোচন,
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও ধর্মান্ধতার উত্থান,
নারীর প্রতি সহিংসতা,
জলবায়ু পরিবর্তন,
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন,

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে বাকস্বাধীনতা হরণ।

এসব প্রশ্নে প্রগতিশীল আন্দোলন আজ নতুন করে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। এ আন্দোলনকে কবিতা শক্তি দিচ্ছে—যেমন করে অতীতে দিয়েছে।

বর্তমানের তরুণ কবিরা রূপক, ইঙ্গিত ও সরাসরি ভাষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন পত্রিকা, কবিতার ভিডিও পারফরম্যান্স—সব মাধ্যমে তাঁরা তাদের প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

কবিতার শক্তি: হৃদয় থেকে আন্দোলনে

কবিতা কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এর প্রধান শক্তি হল—মানুষের বেদনা, ক্ষোভ, স্বপ্নকে স্পর্শ করা। একটুকরো কবিতা কখনো বিশ্লেষণাত্মক রাজনৈতিক ভাষণের চেয়ে অনেক বেশি আন্দোলিত করতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাম্প্রতিক কবিতাগুলিতে দেখা যায়:

  • নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর
  • নারীর স্বাধীনতার দাবি
  • আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রসঙ্গ
  • শ্রমজীবী মানুষের দুঃখগাথা
  • জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এগুলো আন্দোলনের কর্মীদের নতুন করে উজ্জীবিত করে।

আধুনিক মাধ্যম ও কবিতা

ডিজিটাল যুগে কবিতার নাগালও অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম রিল, ব্লগ—সবখানেই কবিতা সহজলভ্য। অনেক কবি স্পোকেন ওয়ার্ড, পারফরম্যান্স পোয়েট্রি বা ভিডিও কবিতার মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প তুলে আনছেন।

কবিতা ও প্রগতিশীল জোট

আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল জোট বা আন্দোলন—যেমন নারী অধিকার আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন—তাদের প্রকাশনা, মিছিল, সভা, পোস্টার—সবখানেই কবিতা ব্যবহার করছে। কবিতার ভাষা সংক্ষিপ্ত, তীব্র এবং হৃদয়বিদারক—যা খুব সহজে জনতার মুখে মুখে ফেরে।

বাংলাদেশের কবিতা অতীতে যেমন প্রগতিশীল আন্দোলনের আত্মা হয়ে উঠেছে, তেমনি আজও সমাজ বদলের স্বপ্নকে প্রাণ জোগাচ্ছে। যখন অন্য সব ভাষা ভয় পায়, তখন কবিতা ভয়হীন। যখন অন্য সব মাধ্যম নীরব হয়, তখন কবিতা উচ্চকণ্ঠে বলে—

“আমি বলি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলো!”

এটাই কবিতার শক্তি—এবং এই শক্তিই আজও বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা।

কুশিয়ারা নদীর দুই শত বছরের ইতিহাস ও জীবনের ধারা

বাংলাদেশের কবিতা কখন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথী হয়

০৩:৫৩:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কবিতা বরাবরই বিপ্লবী চেতনা, মানবিকতা এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমান সময়েও যখন বৈশ্বিক ও স্থানীয় সংকট, সামাজিক বৈষম্য, গণতন্ত্রের সংকোচন, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার ক্রমশ বাড়ছে, তখন কবিতা নতুন করে প্রগতিশীল আন্দোলনকে শক্তি ও ভাষা জোগাচ্ছে।

কবিতার ঐতিহাসিক প্রগতিশীল ভূমিকা

বাংলাদেশের কবিতার প্রগতিশীল ধারা নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক শাসন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে মুকুলিত এই ধারা কায়ক্লেশে লালিত হয়েছে। ঊনিশ ও বিশ শতকের শুরুতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ এবং ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন:

তাঁর বিদ্রোহী কবিতা বা সাম্যবাদী আহ্বান ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল।

একইভাবে, ভাষা আন্দোলনের সময় আবদুল গাফফার চৌধুরীর “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” অথবা শামসুর রাহমানের “ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯” কবিতা জনমনে বিপ্লবী স্পৃহা ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শামসুর রাহমানের “স্বাধীনতা তুমি” বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের বোমার ছেলেকে উৎসর্গ করা কবিতা আমাদের প্রতিরোধ এবং স্বপ্নকে ভাষা দিয়েছিল।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রগতিশীল কবিতা

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি:
রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সংকোচন,
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও ধর্মান্ধতার উত্থান,
নারীর প্রতি সহিংসতা,
জলবায়ু পরিবর্তন,
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন,

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে বাকস্বাধীনতা হরণ।

এসব প্রশ্নে প্রগতিশীল আন্দোলন আজ নতুন করে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। এ আন্দোলনকে কবিতা শক্তি দিচ্ছে—যেমন করে অতীতে দিয়েছে।

বর্তমানের তরুণ কবিরা রূপক, ইঙ্গিত ও সরাসরি ভাষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন পত্রিকা, কবিতার ভিডিও পারফরম্যান্স—সব মাধ্যমে তাঁরা তাদের প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

কবিতার শক্তি: হৃদয় থেকে আন্দোলনে

কবিতা কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এর প্রধান শক্তি হল—মানুষের বেদনা, ক্ষোভ, স্বপ্নকে স্পর্শ করা। একটুকরো কবিতা কখনো বিশ্লেষণাত্মক রাজনৈতিক ভাষণের চেয়ে অনেক বেশি আন্দোলিত করতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাম্প্রতিক কবিতাগুলিতে দেখা যায়:

  • নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর
  • নারীর স্বাধীনতার দাবি
  • আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রসঙ্গ
  • শ্রমজীবী মানুষের দুঃখগাথা
  • জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এগুলো আন্দোলনের কর্মীদের নতুন করে উজ্জীবিত করে।

আধুনিক মাধ্যম ও কবিতা

ডিজিটাল যুগে কবিতার নাগালও অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম রিল, ব্লগ—সবখানেই কবিতা সহজলভ্য। অনেক কবি স্পোকেন ওয়ার্ড, পারফরম্যান্স পোয়েট্রি বা ভিডিও কবিতার মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প তুলে আনছেন।

কবিতা ও প্রগতিশীল জোট

আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল জোট বা আন্দোলন—যেমন নারী অধিকার আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন—তাদের প্রকাশনা, মিছিল, সভা, পোস্টার—সবখানেই কবিতা ব্যবহার করছে। কবিতার ভাষা সংক্ষিপ্ত, তীব্র এবং হৃদয়বিদারক—যা খুব সহজে জনতার মুখে মুখে ফেরে।

বাংলাদেশের কবিতা অতীতে যেমন প্রগতিশীল আন্দোলনের আত্মা হয়ে উঠেছে, তেমনি আজও সমাজ বদলের স্বপ্নকে প্রাণ জোগাচ্ছে। যখন অন্য সব ভাষা ভয় পায়, তখন কবিতা ভয়হীন। যখন অন্য সব মাধ্যম নীরব হয়, তখন কবিতা উচ্চকণ্ঠে বলে—

“আমি বলি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলো!”

এটাই কবিতার শক্তি—এবং এই শক্তিই আজও বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা।