রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে শ্রমিক ফাগুলালের কোনো স্ত্রী নেই। শম্ভু মিত্র মঞ্চ নাটক করার সময় দেখলেন, ফাগুকে শ্রমিক পল্লীতে রাখতে হলে তার একটি সংসার দরকার হয়। পরিবার তৈরি করতে হলে ফাগুলালের স্ত্রীর প্রয়োজন পড়ে। অর্থাৎ একটি শ্রমিক পরিবার। শম্ভু মিত্র চিন্তায় পড়েছিলেন, ফাগুলালের স্ত্রীর শাড়ির মান ও রঙ কেমন হবে তা নিয়ে। যাকে মেলাতে হবে শ্রমিক পল্লীর সঙ্গে। এমন শ্রমিক পল্লীর অনেক পরিচয় বাংলা সাহিত্যে অচিন্ত্য, মানিক, প্রেমেন্দ্র প্রমুখের লেখায় পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শম্ভু মিত্র দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। কিন্তু সবখানে দেখা যাচ্ছে একটা সমাজ আছে। তার একটা কাঠামো আছে। সেই কাঠামোর সবচেয়ে বড় প্রমাণ—ফাগুলালের স্ত্রীর কাপড়ের রঙ ও মান কেমন হবে।
১৯৪৭-এর পরে উভয় পারের বাঙালি সমাজে অনেক বড় ধাক্কা লাগল। সে ধাক্কা যেমন সাহিত্যে, তেমনি সিনেমা এবং মঞ্চেও এল। কিন্তু বাঙালি সবখানে একটা আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করল অনেক কিছু। তাই সাদত হাসান মান্টো, খুশবন্ত সিং, খাজা আহমদ আব্বাস যেমন দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ভেঙে পড়ার শরীরটাকেও আলগা করে দিলেন। মানুষ দেখতে পেল সেখানে সমাজ কতটা ভেঙেছে। বাঙালি তবু সত্যের শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলল না। বাংলা সাহিত্য তাই দেশভাগ ও সমাজের ভাঙনকে অনেকটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নামের মতো ‘আধখানা জীবন’।
বাঙালি কেন সত্যকে আঁচলের তলে রাখল, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তারপরেও কিছু লেখক রিফিউজি ক্যাম্পের মেয়ে চোরাচালানির গল্প, রাজেন তরফদারের মতো পরিচালকের সংসারের সর্বংসহা মাকে লোভী হয়ে যাওয়া এবং নিজের মেয়ের জীবন চুষে খাওয়ার নির্মমতা ঠিকই আনলেন—তারপরেও আধখানা।
কিন্তু আঁচলে সমাজ ঢেকে রাখলেও সমাজ ঢাকা থাকে না। তাই কলকাতার মঞ্চ নাটকে দেখা গেল, সমাজের বখাটে ছেলেরা এসে গুরুজনের সামনে আঙুল তুলে কথা বলছে। অর্থাৎ ফাগুলালদের পরিবারও ভেঙে যাচ্ছে, সেখানে শ্রমিক পল্লীর বদলে অনেকটা বস্তি আসছে। দরমার ঘরেও যে একটা পরিবার ছিল, সেই পরিবারটি নেই। কারণ, আগের পুরুষের মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম, তবলা বা তানপুরা দরমার ঘর থেকে চলে গেছে। সেখানে অন্য কিছু এসেছে।
অন্যদিকে পূর্ববাংলায় সমাজের আরেক রূপান্তর ঘটে। ছোট কৃষক, ভূমিহীন কৃষক পাটের দামের কারণে অনেকটা স্বচ্ছল হন। তাদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় তখনও আধুনিকতার কেন্দ্রবিন্দু—এরিস্টটল থেকে টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ, রুশো, রাসেল, ইয়েটস, নজরুল, মার্ক্স, এমনকি মার্টিন লুথার কিং অনেকটা জীবন্তভাবে উপস্থিত। আর তাদের সঙ্গে উপস্থিত আছে ফাঁসির দড়ি ও জীবন উৎসর্গের সঙ্গে মাস্টারদা সূর্যসেন ও প্রীতিলতা। বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ভাষা আন্দোলনের পলাশের রঙ। যেখানে আল মাহমুদ লিখছেন, “পাহাড়তলীর মরণচূড়ায়/ ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,/ ফেব্রুয়ারির শোকের বসন/ পরল তারই ভগ্নী।”
তাই পূর্ববাংলা থেকে ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দুরা চলে যেতে থাকলেও এখানে সমাজে একটি ভিন্ন কাঠামো গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় শিল্পে ভাঙন লাগায় শ্রমিক পল্লী ভেঙে বস্তি গড়ে ওঠে। অন্যদিকে পূর্ববাংলার (পরে পূর্ব পাকিস্তান) রাজধানী ঢাকায় কৃষক পরিবার থেকে এসে মধ্যবিত্ত হওয়া, দেশচেতনার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটা টানাটানি শুরু হয়। যেন কে আগে সেই প্রগতিকে গ্রহণ করবে। মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু প্রতিনিয়ত চলে যেতে থাকল, তার শূন্যস্থান শতভাগ পূরণ না হলেও প্রাণের একটি উৎসব ঠিকই শুরু হল। আর প্রাণের উৎসব শুরু হলে প্রাণের ভয় কমে যায়—তখন পরিবর্তন আনতে কেউ প্রাণ দিতে দ্বিধা করে না।
এর ফলে প্রাণের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে নতুন দেশ সৃষ্টি হল। কিন্তু নতুন দেশের সমাজে একটু হলেও নাড়া লাগল। মাহমুদুল হকের উপন্যাস, আল মাহমুদের উপন্যাস এবং আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেখানে পরিবার তার মুক্তিসেনানীকে অবজ্ঞা করছে। ভুলে যাচ্ছে আনন্দের দিনে, উৎসবের দিনে, এমনকি প্রতিদিনেই তাঁর অবদানকে।
নাটক ও উপন্যাস পরিবারকে দেখিয়েছে, কিন্তু পাঠক সচেতনভাবে দেখে—রাষ্ট্র ও সমাজ মুক্তিসেনানীকে অবজ্ঞা করেছে। যার ফলে স্বাধীনতার নায়ক তিন বছরেই রক্তাক্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাও লুটিয়ে পড়ল।
এর পরে সমাজ ও রাজনীতি আর সেই ‘জীবন থেকে নেয়ার’ আত্মত্যাগী মধ্যবিত্ত পরিবার ও আল মাহমুদের শোকের বসন পরা ভগ্নির হাতে রইল না।
বরং আশির দশকের শুরুতেই সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র যে কোথায় চলে গেছে, তার প্রকৃত রূপ তুলে আনলেন আমজাদ হোসেন তাঁর ‘গোলাপি এখন ঢাকায়’ ছায়াছবিতে। আসলে দুর্বৃত্তরা তখন বস্তির নষ্ট ছেলেমেয়ে দিয়ে সমাজ ও রাজনীতির নামে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলকেন্দ্রিক সেই জ্ঞান ও বিনয়ের শিক্ষার বদলে ততদিনে কালো চশমা, হোন্ডা, হকিস্টিকের রাজত্ব চলছে।
এর পর নব্বইয়ের বাংলাদেশের রাজধানী ও আশেপাশে গড়ে উঠতে লাগল নতুন নতুন শ্রমাঞ্চল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ আয়তনের বস্তি। এই বস্তির সঙ্গে মিল নেই কোনো শ্রম পল্লীর। এসব বস্তির মানুষের জন্য যেমন কারখানায় কাজ এল, তেমনি অপরাধের নানান দিগন্তও খুলতে থাকে। অন্ধকার নামতেই আলাদা রাজত্ব। আর সে রাজত্বের রাজা—মাদক।
মাদকের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে যেতে লাগল রাষ্ট্র পরিচালনার আশেপাশে থাকা অনেক নাম। আবার, মাদক কি শুধু ব্যবসার জন্য নাকি নেশায় বুদ একটি শ্রেণী তৈরির উদ্দেশ্যে—তাও বড় প্রশ্ন এ সমাজে। এই মাদক শুধু বস্তিতে রইল না; বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শহরের মেস জীবন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।
সত্তরের দশকে ঢাকার মেস জীবন নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে এমন কোনো মেস পাইনি, যেখানে বিখ্যাত কেউ না ছিলেন। তিরিশ বছর ধরে এক মেসে আছেন, তাঁর অনেক পড়ার বই তেলচিটচিটে হয়ে গেছে। আর এখন যেসব মেসের খবর পাই, তা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ধ্যার পরের চিত্রের সঙ্গে মিলে যায়। এমনকি এখন যাদের জ্ঞানের বহরে ইউটিউব ভেসে যায়, তারা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সম্পর্কে যা বলেন, তাতেই তাদের অজ্ঞতার চরম প্রকাশ ঘটে।
অন্যদিকে পপুলিস্ট রাজনীতি ডিগ্রির ছড়াছড়ি করে দিয়েছে। শহর জুড়ে বইয়ের দোকানের খরা। প্রতি বছর বইয়ের দোকান মারা যেতে যেতে এখন চিলে কোঠায় উঠে গেছে বইয়ের দোকান। যার ফলে শিক্ষা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে নীলক্ষেতের মতো নানান ক্ষেতের নোটের ভেতর। আর পপুলিস্ট রাজনীতির ‘শিক্ষা বিস্তার’-এর ফলে সমাজবর্জিত ও সংস্কৃতিহীন এক ধরনের ডিগ্রিধারী সৃষ্টি হয়েছে। আর যখন শিক্ষার সঙ্গে আধুনিকতা, সংস্কৃতি সম্পন্ন সমাজের যোগ ও ভবিষ্যতমুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ থাকে না, তখন শিক্ষিত তরুণরাও নান্দীকারের মঞ্চ নাটকের ওই তরুণদের মতো সমাজ ও সভ্যতা বহির্ভূত বস্তি কালচারের বেয়াদব হয়। তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না গুরুজনের ওপর বেয়াদবি করতে। এমনকি সংকীর্ণ শিক্ষা তাদের রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙতে উদ্যত করে। এক অশ্লীল আনন্দে তারা জাতি, সমাজ ও ভদ্র মানুষ স্রষ্টাদের মূর্তি মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ষাটের দশকে কলকাতায় এই মূর্তি ভাঙা দেখেছি। আজ রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙা, তাঁর বাড়ি ভাঙা যখন দেখি, তখন এই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেবলই প্রশ্ন জাগে—সার্টিফিকেট পাবার কারখানা তৈরির আগে কি একটি সংস্কৃতিবান সমাজ গড়া প্রয়োজন নয়!
কিন্তু ফাগুলালের শ্রমপল্লী থেকে যেভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তার বিপরীতে নতুন সহস্রাব্দ আসতেই দেখা গেল আমজাদ হোসনের সেই বস্তির নায়করা রাজনীতির নায়ক হয়ে উঠছে।
আমাদের মঞ্চ, কলকাতার মঞ্চ অনেক বেশি পুরোনো দিনের নাটক—অনেক সময় শেকসপিয়ারকেও ভেঙে—চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সম্প্রতি ছোটভাই ও বন্ধু সুব্রত সেন সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসকে এই সময়ের উপযোগী করে চলচ্চিত্র করেছেন। সেখানে আন্দোলন করার জন্য, আন্দোলন ভাঙার জন্য যাদের ব্যবহার করেছেন, তাদের মুখের ভাষা সমরেশ বসুর ভাষা নয়—এই সময়ের ভাষা। তারা এই সময়ের একটি বড় তরুণ শ্রেণির প্রতিনিধি। আমজাদ হোসেন, জহির রায়হান বেঁচে থাকলে তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে আসতে পারতেন, যা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত।
তবে তৃতীয় বিশ্বই নয়, গোটা বিশ্বকে ভাবতে হবে—সংস্কৃতি ছাড়া শিক্ষা আসলেই টাইম বোমা কি না, যা ফিলিস্তিন, সিরিয়া থেকে শুরু করে বাঙালির সভ্যতাকেও ধ্বংস করে দিতে পারে।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক ‘সারাক্ষণ’ ও The Present Worl.