০২:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

৪ জুন তিয়ানানমেন ট্র্যাজেডির বই এখন হংকংয়ে দুর্লভ

রাজনৈতিক সেন্সরশিপে হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস

তিয়ানানমেন স্কয়ার গণহত্যা নিয়ে লেখা বইগুলো এখন হংকংয়ের স্বাধীন বইয়ের দোকানগুলোতে ক্রমেই বিরল হয়ে উঠেছে। বিক্রেতারা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বই বিক্রি করা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও শাস্তির ভয়ে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ মেনে চলছেন।

শুধু বই নয়, ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রতি বছরের ৪ জুনের মোমবাতি প্রজ্বালন অনুষ্ঠানটিও নিষিদ্ধ হওয়ায় এই স্মৃতিচারণ এখন অনেকটাই ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে। জনস্মৃতির এই পরিবর্তন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাস কীভাবে সংরক্ষিত হবে, সে বিষয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

গ্রন্থাগার ও বাজার থেকে বিলুপ্তি

২০০৯ সালে হোম অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায়, তখন হংকংয়ের সরকারি গ্রন্থাগারে ১,১৬২ কপি বই ছিল তিয়ানানমেন প্রসঙ্গে। কিন্তু এখন এই শিরোনামগুলো সরকারি অনলাইন ক্যাটালগে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

সরকারি গ্রন্থাগারগুলো জানিয়েছে, তারা নিয়মিত বই পর্যালোচনা করে সরিয়ে নিচ্ছে, যেন সেগুলো হংকংয়ের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারেও কিছু বই আছে, কিন্তু সেগুলো কেবল শিক্ষার্থী ও কর্মীদের জন্য সীমাবদ্ধ।

স্বাধীন বইয়ের দোকানে সংকট ও ভয়

হংকংয়ের স্বাধীন বইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি দোকানে কিছু পুরনো বই দেখা গেছে, তাও মূলত সেকেন্ড হ্যান্ড দোকানে। ওই বইগুলোর মধ্যে ছিল:

  • লিউ শিয়াওবো’র The Monologues of a Doomsday’s Survivor
  • লুইসা লিম-এর The People’s Republic of Amnesia
  • বিক্ষোভ নেতা ওয়াং ডানের স্মৃতিকথা
  • May 35th ও The Bloody Clearing of Tiananmen Square

এই বইগুলোর বেশিরভাগই তাইওয়ানে প্রকাশিত হয়েছে, এবং সংবেদনশীলতার কারণে দোকানের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

রেড লাইন’ নিয়ে আতঙ্ক

শাম শুই পো-র হান্টার বুকস্টোরের মালিক লেটিসিয়া ওং বলেন, “কেউ জানে না ‘রেড লাইন’ আসলে কোথায়। তাই কেউ সাহস করে পরীক্ষা করতেও চায় না।” তার মতে, বইগুলোতে অনেক সময় সত্য-ভিত্তিক বিবরণ থাকলেও কিছু বই রাজনৈতিক মতামতে পূর্ণ, আবার কিছু নাট্যরূপে রচিত।

প্রকাশক এবং বিক্রেতারা জানেন না কোন বই সমস্যাজনক হতে পারে এবং কোন আইনে তাদের বিচারের মুখে পড়তে হতে পারে। এক বই বিক্রেতা বলেন, “আমরা এখন আর এই বই বিক্রি করি না, কারণ আমাদের কাছে বিক্রির মতো আর কিছুই নেই।”

পাঠকের আগ্রহেও ভাটা

ইয়ুয়েন লংয়ের ‘লিটললিটলবুকস’-এর মালিক জেইসন ইউ জানান, “সেন্সরশিপ অবশ্যই একটি বড় বিষয়, তবে পাঠকদের আগ্রহও কমে গেছে।” তার মতে, বর্তমান চীনা তরুণ প্রজন্ম ২০১৯ সালের হংকং আন্দোলন নিয়ে বেশি আগ্রহী, ১৯৮৯-এর ঘটনাটি তাদের স্মৃতির বাইরে।

ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা?

তিয়ানানমেন স্কয়ার গণআন্দোলনে গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে চীনা সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত অভিযান চলে। সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা ৩০০ বলা হলেও ছাত্র ইউনিয়নের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৪,০০০ পর্যন্ত হতে পারে।

মেইনল্যান্ড চীনে এই ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা নিষিদ্ধ। হংকংয়ে আগে প্রকাশ্যে আলোচনা ও মোমবাতি প্রজ্বলনের আয়োজন হতো, যা ২০২০ সাল থেকে কোভিড-১৯-এর অজুহাতে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যালায়েন্স ইন সাপোর্ট অব প্যাট্রিয়টিক ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টস অব চায়না তখন থেকেই ভেঙে যায়।

তাইওয়ান এখন স্মৃতির সংরক্ষক

২০২৪ সালে হংকং সরকার নিজস্ব একটি নিরাপত্তা আইন পাস করে, যার আওতায় গুপ্তচরবৃত্তি ও বিদেশি হস্তক্ষেপকে শাস্তিযোগ্য করা হয়। এতে আগে থেকেই বিদ্যমান বেইজিং-এর জাতীয় নিরাপত্তা আইনের কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পায়।

এই প্রেক্ষাপটে, তাইওয়ান এখন এই স্মৃতির সংরক্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে। দেশটির জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকাডেমিয়া সিনিকা একটি অনলাইন ডেটাবেস চালু করেছে, যেখানে ২০০টিরও বেশি বই, তথ্যচিত্র, এবং ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্য উপকরণ সংরক্ষিত রয়েছে।

এই সংগ্রহে ভিক্টোরিয়া পার্কের পুরনো অনুষ্ঠানপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রকাশনাও অন্তর্ভুক্ত।

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে জানবে?

চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর যোগাযোগ বিষয়ক অধ্যাপক ফ্রান্সিস লি লাপ-ফাং বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অজানা ‘রেড লাইন’-এর ফলে স্মৃতিচারণ এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যারা হৃদয় থেকে মনে রাখেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে স্মরণ করছেন।”

তবে তিনি সতর্ক করেন, “নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস বোঝানো এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ৪ জুন এখন একটি অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে, আর এভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার উত্তরাধিকার ভেঙে পড়ছে।”

৪ জুন তিয়ানানমেন ট্র্যাজেডির বই এখন হংকংয়ে দুর্লভ

১০:০০:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

রাজনৈতিক সেন্সরশিপে হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস

তিয়ানানমেন স্কয়ার গণহত্যা নিয়ে লেখা বইগুলো এখন হংকংয়ের স্বাধীন বইয়ের দোকানগুলোতে ক্রমেই বিরল হয়ে উঠেছে। বিক্রেতারা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বই বিক্রি করা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও শাস্তির ভয়ে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ মেনে চলছেন।

শুধু বই নয়, ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রতি বছরের ৪ জুনের মোমবাতি প্রজ্বালন অনুষ্ঠানটিও নিষিদ্ধ হওয়ায় এই স্মৃতিচারণ এখন অনেকটাই ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে। জনস্মৃতির এই পরিবর্তন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাস কীভাবে সংরক্ষিত হবে, সে বিষয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

গ্রন্থাগার ও বাজার থেকে বিলুপ্তি

২০০৯ সালে হোম অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায়, তখন হংকংয়ের সরকারি গ্রন্থাগারে ১,১৬২ কপি বই ছিল তিয়ানানমেন প্রসঙ্গে। কিন্তু এখন এই শিরোনামগুলো সরকারি অনলাইন ক্যাটালগে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

সরকারি গ্রন্থাগারগুলো জানিয়েছে, তারা নিয়মিত বই পর্যালোচনা করে সরিয়ে নিচ্ছে, যেন সেগুলো হংকংয়ের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারেও কিছু বই আছে, কিন্তু সেগুলো কেবল শিক্ষার্থী ও কর্মীদের জন্য সীমাবদ্ধ।

স্বাধীন বইয়ের দোকানে সংকট ও ভয়

হংকংয়ের স্বাধীন বইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি দোকানে কিছু পুরনো বই দেখা গেছে, তাও মূলত সেকেন্ড হ্যান্ড দোকানে। ওই বইগুলোর মধ্যে ছিল:

  • লিউ শিয়াওবো’র The Monologues of a Doomsday’s Survivor
  • লুইসা লিম-এর The People’s Republic of Amnesia
  • বিক্ষোভ নেতা ওয়াং ডানের স্মৃতিকথা
  • May 35th ও The Bloody Clearing of Tiananmen Square

এই বইগুলোর বেশিরভাগই তাইওয়ানে প্রকাশিত হয়েছে, এবং সংবেদনশীলতার কারণে দোকানের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

রেড লাইন’ নিয়ে আতঙ্ক

শাম শুই পো-র হান্টার বুকস্টোরের মালিক লেটিসিয়া ওং বলেন, “কেউ জানে না ‘রেড লাইন’ আসলে কোথায়। তাই কেউ সাহস করে পরীক্ষা করতেও চায় না।” তার মতে, বইগুলোতে অনেক সময় সত্য-ভিত্তিক বিবরণ থাকলেও কিছু বই রাজনৈতিক মতামতে পূর্ণ, আবার কিছু নাট্যরূপে রচিত।

প্রকাশক এবং বিক্রেতারা জানেন না কোন বই সমস্যাজনক হতে পারে এবং কোন আইনে তাদের বিচারের মুখে পড়তে হতে পারে। এক বই বিক্রেতা বলেন, “আমরা এখন আর এই বই বিক্রি করি না, কারণ আমাদের কাছে বিক্রির মতো আর কিছুই নেই।”

পাঠকের আগ্রহেও ভাটা

ইয়ুয়েন লংয়ের ‘লিটললিটলবুকস’-এর মালিক জেইসন ইউ জানান, “সেন্সরশিপ অবশ্যই একটি বড় বিষয়, তবে পাঠকদের আগ্রহও কমে গেছে।” তার মতে, বর্তমান চীনা তরুণ প্রজন্ম ২০১৯ সালের হংকং আন্দোলন নিয়ে বেশি আগ্রহী, ১৯৮৯-এর ঘটনাটি তাদের স্মৃতির বাইরে।

ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা?

তিয়ানানমেন স্কয়ার গণআন্দোলনে গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে চীনা সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত অভিযান চলে। সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা ৩০০ বলা হলেও ছাত্র ইউনিয়নের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৪,০০০ পর্যন্ত হতে পারে।

মেইনল্যান্ড চীনে এই ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা নিষিদ্ধ। হংকংয়ে আগে প্রকাশ্যে আলোচনা ও মোমবাতি প্রজ্বলনের আয়োজন হতো, যা ২০২০ সাল থেকে কোভিড-১৯-এর অজুহাতে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যালায়েন্স ইন সাপোর্ট অব প্যাট্রিয়টিক ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টস অব চায়না তখন থেকেই ভেঙে যায়।

তাইওয়ান এখন স্মৃতির সংরক্ষক

২০২৪ সালে হংকং সরকার নিজস্ব একটি নিরাপত্তা আইন পাস করে, যার আওতায় গুপ্তচরবৃত্তি ও বিদেশি হস্তক্ষেপকে শাস্তিযোগ্য করা হয়। এতে আগে থেকেই বিদ্যমান বেইজিং-এর জাতীয় নিরাপত্তা আইনের কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পায়।

এই প্রেক্ষাপটে, তাইওয়ান এখন এই স্মৃতির সংরক্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে। দেশটির জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকাডেমিয়া সিনিকা একটি অনলাইন ডেটাবেস চালু করেছে, যেখানে ২০০টিরও বেশি বই, তথ্যচিত্র, এবং ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্য উপকরণ সংরক্ষিত রয়েছে।

এই সংগ্রহে ভিক্টোরিয়া পার্কের পুরনো অনুষ্ঠানপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রকাশনাও অন্তর্ভুক্ত।

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে জানবে?

চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর যোগাযোগ বিষয়ক অধ্যাপক ফ্রান্সিস লি লাপ-ফাং বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অজানা ‘রেড লাইন’-এর ফলে স্মৃতিচারণ এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যারা হৃদয় থেকে মনে রাখেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে স্মরণ করছেন।”

তবে তিনি সতর্ক করেন, “নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস বোঝানো এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ৪ জুন এখন একটি অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে, আর এভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার উত্তরাধিকার ভেঙে পড়ছে।”