ট্রাম্প প্রশাসনের কড়াকড়িতে বদলে যাচ্ছে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের পক্ষ থেকে চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা সীমিত করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে চীনের বহু পরিবার তাদের সন্তানের উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার অনিশ্চয়তা, খরচ এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিবেচনায় এনে এখন অনেক অভিভাবক কানাডা, যুক্তরাজ্য বা জাপানের মতো বিকল্প দেশ খুঁজে দেখছেন।
ভিসা বাতিলের হুমকি ও হার্ভার্ডে বিদেশি শিক্ষার্থী কমানোর প্রস্তাব
গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী কিংবা ‘সংবেদনশীল ক্ষেত্রে’ পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা হবে। একই সঙ্গে সারা বিশ্বে মার্কিন দূতাবাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিসা ইন্টারভিউ স্থগিত করা হয়েছে।
পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক ঘোষণায়—তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের হার ৩০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। যুক্তি হিসেবে বলেন, মার্কিন শিক্ষার্থীরা এতে সুযোগ হারাচ্ছেন।
এর কয়েকদিন আগেই মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তর হার্ভার্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি আটকে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল, যদিও পরে আদালতের এক রায়ে তা স্থগিত হয়।
চীনের অভিভাবকদের দোটানা
সাংহাইয়ের এক অভিভাবক হুয়াং চিউপিং, যাঁর ছেলে ১১ শ্রেণিতে পড়ছে এবং Northwestern University-তে সাংবাদিকতা পড়ার স্বপ্ন দেখছিল, জানান, ‘‘আমি বরাবরই ট্রাম্পের ‘পাগলামো’ নিয়ে চিন্তিত। বছরে ১ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করে ওকে পড়াতে গেলে, সেটা আদৌ সঠিক বিনিয়োগ কিনা সেটা এখন প্রশ্ন।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘পড়াশোনা শেষে চাকরি পাবে তো? চাকরি পেলেও কি সে বৈধভাবে থেকে যেতে পারবে? এসব প্রশ্ন আমাদের কানাডা ভাবতে বাধ্য করছে।’’
তার ছেলে মনে করে, ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হবে না, তবে তবুও কানাডা এখন অনেক বেশি ‘বাস্তববাদী’ বিকল্প।
জাপানে ঝুঁকছেন কেউ কেউ
অপর এক অভিভাবক মাইক ইউ জানান, তাঁর মেয়ে আগে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন জাপানকেই বেছে নিয়েছে। ‘‘যুক্তরাষ্ট্রে এখন যাওয়া মানে অনেক বড় ঝুঁকি। জাপানে এক বছর বেশি ভাষা শিখতে হলেও, খরচ কম, কাছাকাছি, আর চাকরির সুযোগও ভালো।’’
ব্রিটিশ পাঠক্রম ও কমনওয়েলথমুখী পরিকল্পনা
সাংহাইয়ের একটি বিদেশে পাঠানোর সেবাদাতা সংস্থার বিক্রয় ব্যবস্থাপক বেন ওয়াং বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে যত নতুন আন্তর্জাতিক স্কুল তৈরি হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই A-Level ভিত্তিক ব্রিটিশ পাঠক্রম অনুসরণ করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনিশ্চিত, ঝুঁকি ও খরচ উভয়ই বেশি।’’
তিনি আরও জানান, এখনো কিছু পরিবার যুক্তরাষ্ট্রকে প্রাধান্য দিলেও, তারা এখন সংখ্যালঘু।
ভিসা কড়াকড়ির বাস্তব প্রভাব ও অর্থনৈতিক চিন্তা
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রায় ২৫ শতাংশই ছিলেন চীনা নাগরিক। আর ভারতীয় শিক্ষার্থী ছিলেন ২৯ শতাংশ—Institute of International Education-এর Open Doors 2024 রিপোর্ট অনুযায়ী।
তবে অনেক শিক্ষাবিশেষজ্ঞ মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা সীমাবদ্ধতার তৎক্ষণাৎ প্রভাব স্নাতক ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষার্থীদের ওপর কম পড়বে।
সাংহাইয়ের শিক্ষাপরামর্শক লিয়া লিন বলেন, ‘‘ট্রাম্পের এসব ঘোষণা হাস্যকর, কিছুদিন পরেই এসব বদলে যায়। আমরা অভিভাবকদের বলি, এ নিয়ে আতঙ্কিত না হতে।’’
তাঁর মতে, গবেষণাধর্মী উচ্চতর প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের ভিসা নিয়ে কিছু কড়াকড়ি থাকলেও, সাধারণ স্নাতক-মাস্টার্স পর্যায়ে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো চীনা শিক্ষার্থী গ্রহণ করছে।
লিয়া লিন আরও বলেন, ‘‘নৈতিক-রাজনৈতিক দিকের তুলনায় অনেক পরিবার অর্থনৈতিক কারণে বেশি দ্বিধায় থাকে। তবে যেসব পরিবারের শিক্ষা খাতে বাজেট বেশি, তারা পরিকল্পনা বদলায় না।’’
যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে চীনের অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়ছে। ফলস্বরূপ, অনেকেই কানাডা, যুক্তরাজ্য ও জাপানের দিকে ঝুঁকছেন। উচ্চশিক্ষা এখন শুধু স্বপ্ন নয়, তা বাস্তবতাভিত্তিক একটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে পরিণত হয়েছে। এতে ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর আকর্ষণ কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যাচ্ছে।