০৪:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

পর্ব ৪: ‘চাকা’ — রাষ্ট্র ও মানবিক সংকটের দার্শনিক নাটক

নাটকের নাম: চাকা
রচয়িতা: সেলিম আল দীন
পরিচালনা: নাসির উদ্দীন ইউসুফ
প্রচারকাল: ঈদুল ফিতর, ১৯৮৩, বাংলাদেশ টেলিভিশন
অভিনয়: মামুনুর রশীদ, ফারুক আহমেদ, আলী যাকের
প্রধান চরিত্র: মৃতদেহবাহক (মামুনুর রশীদ)

নাটকের সারসংক্ষেপ ও বিশ্লেষণ:

‘চাকা’ নাটকটি একটি প্রতীকধর্মী ও দার্শনিক নাটক, যা কেবল একটি মৃতদেহ বহনের গল্প নয়—বরং রাষ্ট্রের দায়হীনতা, মানবিকতা এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ববোধ নিয়ে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে। গল্পটি আবর্তিত হয় মৃতদেহ বহনকারী দুই ব্যক্তি এবং তাদের মূক ও শ্রান্ত ভ্রমণকে ঘিরে। তারা একটি অজ্ঞাত মৃতদেহ গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করার চেষ্টা করে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াতেই উঠে আসে সমাজের মূল্যবোধ, প্রশাসনিক জটিলতা ও মানবিক সংকট।

নাটকটিতে মৃতদেহটিই হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী প্রতীক—এটি মৃত কোনো এক ব্যক্তি নয়, বরং রাষ্ট্রের নির্দয় আচরণের প্রতিফলন, একটি অমানবিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর নিদর্শন। নাটকের এক পর্যায়ে মামুনুর রশীদের চরিত্রটি প্রশ্ন তোলে, “এই দেহটা কার? যদি কেউই না জানে, তবে আমরা বইছি কেন?” এই সংলাপে উঠে আসে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার বিরুদ্ধে এক অব্যক্ত প্রতিবাদ।

অভিনয় ও চরিত্র বিশ্লেষণ:

মামুনুর রশীদ এই নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তার মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, এবং সংলাপ বলার ধরণ নাটকের মূল বেদনার আবহ তৈরি করে। বিশেষ করে, তার চরিত্রটির ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ অথচ নিরুপায় চেহারায় প্রতিটি দর্শক নিজের ব্যর্থতাকে খুঁজে পান।

ফারুক আহমেদ অপর চরিত্রে ছিলেন, যিনি নিষ্পৃহ অথচ বাস্তববাদী। তার সংলাপ কম, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি চরিত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। আলী যাকেরের চরিত্রটি প্রশাসনিক প্রতীক হিসেবে নাটকে সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতেই এক শীতল বোধ এনে দেয়। তিনি বলেন, “আমার নিয়ম ছাড়া কবর হয় না,” যা রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তাকে তুলে ধরে।

নির্দেশনা ও চিত্রনির্মাণ:

নাসির উদ্দীন ইউসুফ নাটকটিকে যেভাবে পরিচালনা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। তিনি নাটকটিকে ধারণ করেছেন প্রকৃতির মাঝে—খোলা মাঠ, কাদা-পানিতে ভরা পথ, গাঢ় আলোছায়া এবং রুক্ষ বাতাসের মাঝে প্রতিটি দৃশ্য যেন বাস্তবতাকে আঁচ করতে বাধ্য করে। ক্যামেরার চলাচল ছিল ধীর, সংলাপের ফাঁকে ছিল দীর্ঘ নীরবতা যা দর্শককে ভাবনার জায়গা দেয়।

আবহসঙ্গীতে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না, ছিল শুধু হাঁটার শব্দ, গাছের পাতার আওয়াজ, আর দূরের কাকের ডাক—যা নাটকের নির্জনতা ও প্রতীকী বেদনা আরও বাড়িয়ে তোলে।

প্রতীকী দিক:

নাটকে ‘চাকা’ প্রতীক হিসেবে এসেছে এক ধারাবাহিক ঘূর্ণনের, যেটি চলতেই থাকে—দায়িত্ব এড়ানো, শূন্যতার চাকা। মৃতদেহটি যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যক্ত অপরাধবোধ, যার ভার কেউ নিতে চায় না। ‘চাকা’ শব্দটির মধ্যে রয়ে গেছে একটি আবর্তন, একটি বাধ্যতা, আর অন্ধ গন্তব্যের দিকে চলা।

নাটকটিতে কোনো নির্দিষ্ট ঈদ আনন্দ নেই, নেই কোনো রঙচঙে আলোকসজ্জা—তবে এই নির্জনতা এবং একাকীত্বই নাটকটির প্রকৃত শক্তি। এটি দর্শককে ঈদের দিনেও ভাবনার জগতে নিয়ে যায়।

‘চাকা’ ছিল এমন একটি নাটক যা ঈদের আনন্দ থেকে বেরিয়ে দর্শককে ভাবনার জগতে প্রবেশ করায়। পরে এই নাটক চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হলেও, টেলিভিশনে এর প্রচার দর্শকের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

পর্ব ৪: ‘চাকা’ — রাষ্ট্র ও মানবিক সংকটের দার্শনিক নাটক

১০:০০:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ জুন ২০২৫

নাটকের নাম: চাকা
রচয়িতা: সেলিম আল দীন
পরিচালনা: নাসির উদ্দীন ইউসুফ
প্রচারকাল: ঈদুল ফিতর, ১৯৮৩, বাংলাদেশ টেলিভিশন
অভিনয়: মামুনুর রশীদ, ফারুক আহমেদ, আলী যাকের
প্রধান চরিত্র: মৃতদেহবাহক (মামুনুর রশীদ)

নাটকের সারসংক্ষেপ ও বিশ্লেষণ:

‘চাকা’ নাটকটি একটি প্রতীকধর্মী ও দার্শনিক নাটক, যা কেবল একটি মৃতদেহ বহনের গল্প নয়—বরং রাষ্ট্রের দায়হীনতা, মানবিকতা এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ববোধ নিয়ে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে। গল্পটি আবর্তিত হয় মৃতদেহ বহনকারী দুই ব্যক্তি এবং তাদের মূক ও শ্রান্ত ভ্রমণকে ঘিরে। তারা একটি অজ্ঞাত মৃতদেহ গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করার চেষ্টা করে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াতেই উঠে আসে সমাজের মূল্যবোধ, প্রশাসনিক জটিলতা ও মানবিক সংকট।

নাটকটিতে মৃতদেহটিই হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী প্রতীক—এটি মৃত কোনো এক ব্যক্তি নয়, বরং রাষ্ট্রের নির্দয় আচরণের প্রতিফলন, একটি অমানবিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর নিদর্শন। নাটকের এক পর্যায়ে মামুনুর রশীদের চরিত্রটি প্রশ্ন তোলে, “এই দেহটা কার? যদি কেউই না জানে, তবে আমরা বইছি কেন?” এই সংলাপে উঠে আসে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার বিরুদ্ধে এক অব্যক্ত প্রতিবাদ।

অভিনয় ও চরিত্র বিশ্লেষণ:

মামুনুর রশীদ এই নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তার মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, এবং সংলাপ বলার ধরণ নাটকের মূল বেদনার আবহ তৈরি করে। বিশেষ করে, তার চরিত্রটির ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ অথচ নিরুপায় চেহারায় প্রতিটি দর্শক নিজের ব্যর্থতাকে খুঁজে পান।

ফারুক আহমেদ অপর চরিত্রে ছিলেন, যিনি নিষ্পৃহ অথচ বাস্তববাদী। তার সংলাপ কম, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি চরিত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। আলী যাকেরের চরিত্রটি প্রশাসনিক প্রতীক হিসেবে নাটকে সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতেই এক শীতল বোধ এনে দেয়। তিনি বলেন, “আমার নিয়ম ছাড়া কবর হয় না,” যা রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তাকে তুলে ধরে।

নির্দেশনা ও চিত্রনির্মাণ:

নাসির উদ্দীন ইউসুফ নাটকটিকে যেভাবে পরিচালনা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। তিনি নাটকটিকে ধারণ করেছেন প্রকৃতির মাঝে—খোলা মাঠ, কাদা-পানিতে ভরা পথ, গাঢ় আলোছায়া এবং রুক্ষ বাতাসের মাঝে প্রতিটি দৃশ্য যেন বাস্তবতাকে আঁচ করতে বাধ্য করে। ক্যামেরার চলাচল ছিল ধীর, সংলাপের ফাঁকে ছিল দীর্ঘ নীরবতা যা দর্শককে ভাবনার জায়গা দেয়।

আবহসঙ্গীতে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না, ছিল শুধু হাঁটার শব্দ, গাছের পাতার আওয়াজ, আর দূরের কাকের ডাক—যা নাটকের নির্জনতা ও প্রতীকী বেদনা আরও বাড়িয়ে তোলে।

প্রতীকী দিক:

নাটকে ‘চাকা’ প্রতীক হিসেবে এসেছে এক ধারাবাহিক ঘূর্ণনের, যেটি চলতেই থাকে—দায়িত্ব এড়ানো, শূন্যতার চাকা। মৃতদেহটি যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যক্ত অপরাধবোধ, যার ভার কেউ নিতে চায় না। ‘চাকা’ শব্দটির মধ্যে রয়ে গেছে একটি আবর্তন, একটি বাধ্যতা, আর অন্ধ গন্তব্যের দিকে চলা।

নাটকটিতে কোনো নির্দিষ্ট ঈদ আনন্দ নেই, নেই কোনো রঙচঙে আলোকসজ্জা—তবে এই নির্জনতা এবং একাকীত্বই নাটকটির প্রকৃত শক্তি। এটি দর্শককে ঈদের দিনেও ভাবনার জগতে নিয়ে যায়।

‘চাকা’ ছিল এমন একটি নাটক যা ঈদের আনন্দ থেকে বেরিয়ে দর্শককে ভাবনার জগতে প্রবেশ করায়। পরে এই নাটক চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হলেও, টেলিভিশনে এর প্রচার দর্শকের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।