০২:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ঈদের বাজারে কেন কম খরচের ছায়া

২০২৫ সালের ঈদুল আযহার প্রাক্কালে দেশের কোরবানির হাটগুলোর চিত্র স্পষ্টভাবে পাল্টে গিয়েছিল। বড় গরুর জায়গা দখল করে নিয়েছিল ছোট ও মাঝারি আকৃতির গরু। এই প্রবণতা ছিল শুধু বাজারের নয়, বরং একটি গভীর আর্থ-সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।

ক্রেতার নজর ছিল ক্ষুদ্র গরুর দিকে

ঢাকার গাবতলী, তেজগাঁও ও পূর্বাচলসহ বড় বড় পশুর হাটগুলো ঘুরে দেখা গিয়েছিল, ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে থাকা ছোট গরুর প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ক্রেতারা। উট বা বড় গরু যেন হয়ে উঠেছিল প্রদর্শনীর বস্তু—দেখা হচ্ছিল, দাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল, কিনছিলেন না কেউ।

পাবনা থেকে আনা ১২০০ কেজির “পাবনার ডন” নামের একটি গরুর দাম ১২ লাখ টাকা হাঁকানো হলেও পুরো সপ্তাহজুড়ে একজনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি। অনেক বিক্রেতা শেষ মুহূর্তে দাম অর্ধেকে নামিয়েও গরু বিক্রি করতে পারেননি।

কেন কমেছিল বড় গরুর চাহিদা?

বিক্রেতাদের দাবি ছিল, বড় গরু পালনে খরচ বেশি পড়লেও ক্রেতারা সেসব নিতে আগ্রহ দেখাননি। অনেক খামারি বলেছিলেন, ক্রেতারা কেবল কম দামের গরু খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান উল্লেখ করেছিলেন, “এই পরিবর্তনটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। বড় গরু কেনার মতো সামর্থ্য যাদের এক সময় ছিল, তারা এবার ছোট গরুতে নেমে এসেছেন। দেশের অর্থনীতি ছিল চাপের মধ্যে, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।”

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গাবতলী হাট পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, “আগে দুর্নীতির টাকা ছিল, এখন নেই। এজন্য বড় গরুর বিক্রি কমেছে।” তার মতে, যাদের কাছে কালো টাকা ছিল, তারাই বড় গরু কিনতেন।

অর্থনৈতিক বাস্তবতা: জিডিপি নেমেছিল ৩.৩ শতাংশে

২০২৫ সালের মধ্যেই দেশের জিডিপি হার কমে দাঁড়িয়েছিল ৩.৩ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ঘরে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। আয় না বাড়ায় ঈদের মতো উৎসবেও মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছিল। এর প্রভাব সরাসরি কোরবানির পশুর হাটে পড়েছিল।

ছোট গরুর দামও ছিল কম নয়

যদিও বড় গরুর বিক্রি কমে গিয়েছিল, ছোট গরুর চাহিদার পাশাপাশি দামও ছিল বেশি। দেড় লাখ টাকার নিচে গরু পেতে ক্রেতাদের হিমশিম খেতে হয়েছিল। অনেকে পছন্দের গরু না পেয়ে হাট থেকে হাটে ঘুরেছিলেন। কেউ কেউ নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে পশু না পেয়ে হতাশ হয়ে হাট ত্যাগ করেছিলেন।

শেষ মুহূর্তে ভরসা ছিল ছোট গরুতে

তেজগাঁও হাটের হাসিল কমিটি জানিয়েছিল, প্রায় আট হাজার গরু হাটে উঠেছিল এবং ঈদের আগের রাতেই অধিকাংশ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তবে যেসব বড় গরু ছিল, তার বেশিরভাগই অবিক্রিত থেকে গিয়েছিল।

গাবতলী হাটের একাধিক বিক্রেতা জানিয়েছেন, ছোট গরু থেকে তারা লাভ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বড় গরু নিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন।

‘নীরব দুর্ভিক্ষ’ কি ?

এভাবে বড় গরু বিক্রি না হওয়া, মানুষের বাজেট সংকোচন, নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি—সব মিলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেছনে দেশে এক ধরনের ‘নীরব দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে হয়তো! খাদ্য আছে, তবে পুষ্টিকর খাদ্য, ধর্মীয় উৎসব, বা সামাজিক মর্যাদা রক্ষার মতো খরচ চালানো অনেকের জন্য সম্ভব হচ্ছে না।

উৎসবের পরিবর্তে চলেছিল হিসাবের ঈদ

২০২৫ সালের কোরবানির ঈদ ছিল সংযম আর হিসাব-নিকাশের ঈদ। অনেক খামারি আর্থিক ক্ষতির কথা বলেছিলেন, অনেক ভোক্তা বলেছিলেন, “বাজেটের বাইরে গরু কেনা সম্ভব না।”

এই চিত্র শুধু পশুর হাটের নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন—যেখানে উৎসব ছিল, কিন্তু সেই উৎসবের আয়তন ও রঙ হয়ে পড়েছিল অনেকটাই ফিকে।

ঈদের বাজারে কেন কম খরচের ছায়া

০৩:০৫:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ জুন ২০২৫

২০২৫ সালের ঈদুল আযহার প্রাক্কালে দেশের কোরবানির হাটগুলোর চিত্র স্পষ্টভাবে পাল্টে গিয়েছিল। বড় গরুর জায়গা দখল করে নিয়েছিল ছোট ও মাঝারি আকৃতির গরু। এই প্রবণতা ছিল শুধু বাজারের নয়, বরং একটি গভীর আর্থ-সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।

ক্রেতার নজর ছিল ক্ষুদ্র গরুর দিকে

ঢাকার গাবতলী, তেজগাঁও ও পূর্বাচলসহ বড় বড় পশুর হাটগুলো ঘুরে দেখা গিয়েছিল, ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে থাকা ছোট গরুর প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ক্রেতারা। উট বা বড় গরু যেন হয়ে উঠেছিল প্রদর্শনীর বস্তু—দেখা হচ্ছিল, দাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল, কিনছিলেন না কেউ।

পাবনা থেকে আনা ১২০০ কেজির “পাবনার ডন” নামের একটি গরুর দাম ১২ লাখ টাকা হাঁকানো হলেও পুরো সপ্তাহজুড়ে একজনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি। অনেক বিক্রেতা শেষ মুহূর্তে দাম অর্ধেকে নামিয়েও গরু বিক্রি করতে পারেননি।

কেন কমেছিল বড় গরুর চাহিদা?

বিক্রেতাদের দাবি ছিল, বড় গরু পালনে খরচ বেশি পড়লেও ক্রেতারা সেসব নিতে আগ্রহ দেখাননি। অনেক খামারি বলেছিলেন, ক্রেতারা কেবল কম দামের গরু খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান উল্লেখ করেছিলেন, “এই পরিবর্তনটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। বড় গরু কেনার মতো সামর্থ্য যাদের এক সময় ছিল, তারা এবার ছোট গরুতে নেমে এসেছেন। দেশের অর্থনীতি ছিল চাপের মধ্যে, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।”

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গাবতলী হাট পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, “আগে দুর্নীতির টাকা ছিল, এখন নেই। এজন্য বড় গরুর বিক্রি কমেছে।” তার মতে, যাদের কাছে কালো টাকা ছিল, তারাই বড় গরু কিনতেন।

অর্থনৈতিক বাস্তবতা: জিডিপি নেমেছিল ৩.৩ শতাংশে

২০২৫ সালের মধ্যেই দেশের জিডিপি হার কমে দাঁড়িয়েছিল ৩.৩ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ঘরে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। আয় না বাড়ায় ঈদের মতো উৎসবেও মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছিল। এর প্রভাব সরাসরি কোরবানির পশুর হাটে পড়েছিল।

ছোট গরুর দামও ছিল কম নয়

যদিও বড় গরুর বিক্রি কমে গিয়েছিল, ছোট গরুর চাহিদার পাশাপাশি দামও ছিল বেশি। দেড় লাখ টাকার নিচে গরু পেতে ক্রেতাদের হিমশিম খেতে হয়েছিল। অনেকে পছন্দের গরু না পেয়ে হাট থেকে হাটে ঘুরেছিলেন। কেউ কেউ নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে পশু না পেয়ে হতাশ হয়ে হাট ত্যাগ করেছিলেন।

শেষ মুহূর্তে ভরসা ছিল ছোট গরুতে

তেজগাঁও হাটের হাসিল কমিটি জানিয়েছিল, প্রায় আট হাজার গরু হাটে উঠেছিল এবং ঈদের আগের রাতেই অধিকাংশ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তবে যেসব বড় গরু ছিল, তার বেশিরভাগই অবিক্রিত থেকে গিয়েছিল।

গাবতলী হাটের একাধিক বিক্রেতা জানিয়েছেন, ছোট গরু থেকে তারা লাভ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বড় গরু নিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন।

‘নীরব দুর্ভিক্ষ’ কি ?

এভাবে বড় গরু বিক্রি না হওয়া, মানুষের বাজেট সংকোচন, নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি—সব মিলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেছনে দেশে এক ধরনের ‘নীরব দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে হয়তো! খাদ্য আছে, তবে পুষ্টিকর খাদ্য, ধর্মীয় উৎসব, বা সামাজিক মর্যাদা রক্ষার মতো খরচ চালানো অনেকের জন্য সম্ভব হচ্ছে না।

উৎসবের পরিবর্তে চলেছিল হিসাবের ঈদ

২০২৫ সালের কোরবানির ঈদ ছিল সংযম আর হিসাব-নিকাশের ঈদ। অনেক খামারি আর্থিক ক্ষতির কথা বলেছিলেন, অনেক ভোক্তা বলেছিলেন, “বাজেটের বাইরে গরু কেনা সম্ভব না।”

এই চিত্র শুধু পশুর হাটের নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন—যেখানে উৎসব ছিল, কিন্তু সেই উৎসবের আয়তন ও রঙ হয়ে পড়েছিল অনেকটাই ফিকে।