১২:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পর্ব ২: দুপুরবেলা রাজকীয় ভোজ—পুরান ঢাকার ঈদের আপ্যায়ন

পুরান ঢাকার ঈদের দুপুর মানেই এক অপূর্ব ভোজনের অভিজ্ঞতা। সকালবেলার তাড়াহুড়া, জবাই আর রান্নার প্রস্তুতির পরে দুপুরবেলা যেন রান্নাঘর ও ডাইনিং টেবিল একসঙ্গে পরিণত হয় পারিবারিক মিলনমেলায়। এই সময় অতিথি আপ্যায়ন, সুসজ্জিত খাবারের আয়োজনে ফুটে ওঠে পুরান ঢাকার ঈদ-সংস্কৃতির হৃদয়।

দুপুরবেলা মানেই ভাত-মাংসের বিপুল আয়োজন

ঈদের দুপুরের প্রধান আকর্ষণই হলো ‘গরুর মাংস দিয়ে ভাত’। তবে এটি কোনো সাধারণ রান্না নয়। একেকটি পরিবারে আলাদা আলাদা রীতি, রুচি ও পদ। কেউ করেন গরুর হাড়ঝোলা মাংস, কেউ করেন শাহী কোরমা, আবার কেউ কেউ বানান চাপ, কাবাব বা রেজালা। বহু বাড়িতে এই সময় একাধিক মাংসের পদ তৈরি হয়।

মাংস রান্নায় ব্যবহৃত হয় পুরান ঢাকার নিজস্ব মসলা—নিজেদের গ্রাইন্ড করা গরম মসলা, বিশেষ মেজাজের পেয়াজ বাটা, রসুনের রস, আর ঘন টক দই। এমনকি কেউ কেউ মাংসে ব্যবহার করেন ভাজা বাদাম ও কিশমিশ। এই বিশেষ প্রস্তুতি রাত থেকেই শুরু হয় এবং দুপুরে তা জমকালো ভোজে রূপ নেয়।

অতিথি আপ্যায়ন: এক অনন্য ঐতিহ্য

পুরান ঢাকার ঈদের দুপুর আরেকটি দিক দিয়ে বিখ্যাত—অতিথি আপ্যায়ন। ‘চলেন ভাই, খেয়ে যান’—এই কথাটা এখানে শুধু ভদ্রতা নয়, একধরনের আন্তরিক আমন্ত্রণ। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, পুরনো বন্ধু, এমনকি হঠাৎ দেখা হওয়া অতিথিও নিমন্ত্রণ থেকে বাদ পড়েন না।

বাড়ির সদস্যরা কেউ মেহমানের প্লেটে তুলে দিচ্ছেন মাংসের টুকরো, কেউ চালাচ্ছেন পানির গ্লাস, কেউ রান্নার ইতিহাস বলছেন গল্প করে—সব মিলে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ।

ভাতের পাশে অন্য পদ

দুপুরের ভাত-মাংসের সঙ্গে অনেক সময়ই পরিবেশন করা হয় বেগুন ভাজা, মাশরুম ভাজি, শসা-পেঁয়াজের সালাদ ও আচার। কেউ কেউ বানিয়ে রাখেন বিশেষ তেহারি বা পোলাও, বিশেষ করে যেখানে বেশি অতিথি আসবেন বলে জানেন। আবার কিছু বাড়িতে ‘রোস্ট’ ও ‘গরুর কাবাব’ পরিবেশন করা হয় রুটি বা পরোটার সঙ্গে। অনেক পরিবারে ঈদের দিনে গরুর চর্বি দিয়ে রান্না করা বিশেষ ‘চর্বির খিচুড়ি’ হয়, যা পুরান ঢাকার স্বাদজগতের বিশেষ সম্পদ।

এক ঢোক বোরহানিই সবার প্রিয়

গরুর মাংসের ভারী খাবারের পরে এক গ্লাস ঠান্ডা বোরহানি যেন সবকিছুর পরিপূর্ণতা এনে দেয়। ঘরে ঘরে বানানো হয় এই পানীয়, যাতে থাকে টক দই, পোড়া জিরা, বিট লবণ, পুদিনা পাতা এবং হালকা কাঁচা মরিচ। পুরান ঢাকার অনেক পরিবারে এই বোরহানি রীতিমতো ‘ঈদের অপরিহার্য অংশ’ হিসেবে বিবেচিত।

খাবারের পর একসঙ্গে বসে গল্পগুজব

দুপুরের খাবার শেষে শুরু হয় এক মনোরম আড্ডা পর্ব। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন আগের দিনের ঈদের কথা, ছোটরা মোবাইলে ছবি তোলে, টিভিতে নাটক দেখা চলে, কেউ কেউ পাশের বাড়িতে ঘুরে আসে। পুরান ঢাকার এই গল্পগুজবই সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। কেউ কারো পাতে খাবার তুলে দেওয়া, হেসে হেসে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব আবহ।

নারীদের অবদানকে ভুলে যাওয়া যায় না

এই বিশাল আয়োজনের পেছনে পুরান ঢাকার গৃহিণীদের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নিরন্তর রান্না, পরিবেশন, পরিষ্কার—সবকিছুতেই তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা থাকে। অনেক ঘরে তাঁরা একদিন আগেই মাংস বেছে, মসলা গুঁড়ো করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। এমনকি অতিথিদের পছন্দের রান্না আগেভাগে জেনে নেন কেউ কেউ।

ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরান ঢাকার অনেক পরিবার আধুনিক রান্নার ধারা যুক্ত করেছেন। কেউ করছেন গ্রিল স্টেক, কেউ বানাচ্ছেন মাটন কারি বিদেশি রেসিপিতে। তবে মূল খাবারের কাঠামো ঠিক একই থাকে—মাংসই কেন্দ্রবিন্দু।

এই আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ পুরান ঢাকার ঈদ উৎসবকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। রান্নাঘরে ইলেকট্রিক গ্রাইন্ডার, প্রেসার কুকার, মাইক্রোওভেনের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি আজও কেউ কেউ গ্যাসের চুলা নয়, কয়লার আগুনে পায়া বা চাপ রান্না করেন।

 দুপুর মানেই সম্পর্কের টান

পুরান ঢাকার ঈদের দুপুর শুধু একটি খাবারের আয়োজন নয়, এটি হৃদয়ের বন্ধন দৃঢ় করার এক উপলক্ষ। খাবারের স্বাদে যেমন রাজকীয়তা, তেমনি পরিবেশে থাকে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা। একে অপরের পাশে বসে খাওয়া, নিজের হাতে তুলে দেওয়া, একসঙ্গে হাসা—সব কিছু মিলে ঈদের দুপুরের ভোজন পরিণত হয় এক জীবন্ত উৎসবে।

পর্ব ২: দুপুরবেলা রাজকীয় ভোজ—পুরান ঢাকার ঈদের আপ্যায়ন

০২:৩১:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫

পুরান ঢাকার ঈদের দুপুর মানেই এক অপূর্ব ভোজনের অভিজ্ঞতা। সকালবেলার তাড়াহুড়া, জবাই আর রান্নার প্রস্তুতির পরে দুপুরবেলা যেন রান্নাঘর ও ডাইনিং টেবিল একসঙ্গে পরিণত হয় পারিবারিক মিলনমেলায়। এই সময় অতিথি আপ্যায়ন, সুসজ্জিত খাবারের আয়োজনে ফুটে ওঠে পুরান ঢাকার ঈদ-সংস্কৃতির হৃদয়।

দুপুরবেলা মানেই ভাত-মাংসের বিপুল আয়োজন

ঈদের দুপুরের প্রধান আকর্ষণই হলো ‘গরুর মাংস দিয়ে ভাত’। তবে এটি কোনো সাধারণ রান্না নয়। একেকটি পরিবারে আলাদা আলাদা রীতি, রুচি ও পদ। কেউ করেন গরুর হাড়ঝোলা মাংস, কেউ করেন শাহী কোরমা, আবার কেউ কেউ বানান চাপ, কাবাব বা রেজালা। বহু বাড়িতে এই সময় একাধিক মাংসের পদ তৈরি হয়।

মাংস রান্নায় ব্যবহৃত হয় পুরান ঢাকার নিজস্ব মসলা—নিজেদের গ্রাইন্ড করা গরম মসলা, বিশেষ মেজাজের পেয়াজ বাটা, রসুনের রস, আর ঘন টক দই। এমনকি কেউ কেউ মাংসে ব্যবহার করেন ভাজা বাদাম ও কিশমিশ। এই বিশেষ প্রস্তুতি রাত থেকেই শুরু হয় এবং দুপুরে তা জমকালো ভোজে রূপ নেয়।

অতিথি আপ্যায়ন: এক অনন্য ঐতিহ্য

পুরান ঢাকার ঈদের দুপুর আরেকটি দিক দিয়ে বিখ্যাত—অতিথি আপ্যায়ন। ‘চলেন ভাই, খেয়ে যান’—এই কথাটা এখানে শুধু ভদ্রতা নয়, একধরনের আন্তরিক আমন্ত্রণ। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, পুরনো বন্ধু, এমনকি হঠাৎ দেখা হওয়া অতিথিও নিমন্ত্রণ থেকে বাদ পড়েন না।

বাড়ির সদস্যরা কেউ মেহমানের প্লেটে তুলে দিচ্ছেন মাংসের টুকরো, কেউ চালাচ্ছেন পানির গ্লাস, কেউ রান্নার ইতিহাস বলছেন গল্প করে—সব মিলে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ।

ভাতের পাশে অন্য পদ

দুপুরের ভাত-মাংসের সঙ্গে অনেক সময়ই পরিবেশন করা হয় বেগুন ভাজা, মাশরুম ভাজি, শসা-পেঁয়াজের সালাদ ও আচার। কেউ কেউ বানিয়ে রাখেন বিশেষ তেহারি বা পোলাও, বিশেষ করে যেখানে বেশি অতিথি আসবেন বলে জানেন। আবার কিছু বাড়িতে ‘রোস্ট’ ও ‘গরুর কাবাব’ পরিবেশন করা হয় রুটি বা পরোটার সঙ্গে। অনেক পরিবারে ঈদের দিনে গরুর চর্বি দিয়ে রান্না করা বিশেষ ‘চর্বির খিচুড়ি’ হয়, যা পুরান ঢাকার স্বাদজগতের বিশেষ সম্পদ।

এক ঢোক বোরহানিই সবার প্রিয়

গরুর মাংসের ভারী খাবারের পরে এক গ্লাস ঠান্ডা বোরহানি যেন সবকিছুর পরিপূর্ণতা এনে দেয়। ঘরে ঘরে বানানো হয় এই পানীয়, যাতে থাকে টক দই, পোড়া জিরা, বিট লবণ, পুদিনা পাতা এবং হালকা কাঁচা মরিচ। পুরান ঢাকার অনেক পরিবারে এই বোরহানি রীতিমতো ‘ঈদের অপরিহার্য অংশ’ হিসেবে বিবেচিত।

খাবারের পর একসঙ্গে বসে গল্পগুজব

দুপুরের খাবার শেষে শুরু হয় এক মনোরম আড্ডা পর্ব। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন আগের দিনের ঈদের কথা, ছোটরা মোবাইলে ছবি তোলে, টিভিতে নাটক দেখা চলে, কেউ কেউ পাশের বাড়িতে ঘুরে আসে। পুরান ঢাকার এই গল্পগুজবই সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। কেউ কারো পাতে খাবার তুলে দেওয়া, হেসে হেসে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব আবহ।

নারীদের অবদানকে ভুলে যাওয়া যায় না

এই বিশাল আয়োজনের পেছনে পুরান ঢাকার গৃহিণীদের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নিরন্তর রান্না, পরিবেশন, পরিষ্কার—সবকিছুতেই তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা থাকে। অনেক ঘরে তাঁরা একদিন আগেই মাংস বেছে, মসলা গুঁড়ো করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। এমনকি অতিথিদের পছন্দের রান্না আগেভাগে জেনে নেন কেউ কেউ।

ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরান ঢাকার অনেক পরিবার আধুনিক রান্নার ধারা যুক্ত করেছেন। কেউ করছেন গ্রিল স্টেক, কেউ বানাচ্ছেন মাটন কারি বিদেশি রেসিপিতে। তবে মূল খাবারের কাঠামো ঠিক একই থাকে—মাংসই কেন্দ্রবিন্দু।

এই আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ পুরান ঢাকার ঈদ উৎসবকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। রান্নাঘরে ইলেকট্রিক গ্রাইন্ডার, প্রেসার কুকার, মাইক্রোওভেনের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি আজও কেউ কেউ গ্যাসের চুলা নয়, কয়লার আগুনে পায়া বা চাপ রান্না করেন।

 দুপুর মানেই সম্পর্কের টান

পুরান ঢাকার ঈদের দুপুর শুধু একটি খাবারের আয়োজন নয়, এটি হৃদয়ের বন্ধন দৃঢ় করার এক উপলক্ষ। খাবারের স্বাদে যেমন রাজকীয়তা, তেমনি পরিবেশে থাকে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা। একে অপরের পাশে বসে খাওয়া, নিজের হাতে তুলে দেওয়া, একসঙ্গে হাসা—সব কিছু মিলে ঈদের দুপুরের ভোজন পরিণত হয় এক জীবন্ত উৎসবে।