০৩:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

গ্রামের ঈদে এবার কিছুটা ম্লান ছিলো হাসি

২০২৫ সালের ঈদুল আজহা সামনে রেখে দেশের গ্রামীণ হাটবাজারে যে কোরবানির গরু, ছাগল ও অন্যান্য সামগ্রীর কেনাবেচা হয়েছিল, সেখানে এবার এক ভিন্ন ধারা চোখে পড়েছিল। খামারিদের কণ্ঠে ছিল হতাশা, ক্রেতাদের চোখে ছিল হিসাব-নিকাশ আর বাজারে বিরাজ করেছিল অনিশ্চয়তা—সব মিলে এবারের ঈদের বাজার যেন আরেক রকমের বার্তা বহন করেছিল। অনেকেই বলেছিলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর গরু ও ছাগলের বিক্রি কমেছিল, সেই সঙ্গে ঈদের অন্যান্য কেনাকাটাতেও পড়েছিল প্রভাব।

গরুর হাটে ভিড়, কিন্তু বিক্রি কম

নেত্রকোনার কলমাকান্দার গরুর হাটে গত বছরের তুলনায় এ বছর মানুষ কম গরু কিনেছিল। হাটে গরু ছিল, মানুষও এসেছিল, দরাদরিও হয়েছিল; কিন্তু বিক্রি হয়েছিল অনেক কম। এক খামারি জানিয়েছিলেন, “গতবার একই সময়েই পাঁচটা গরু বিক্রি করেছিলাম, এবার তখনো দুইটার দামেই কুলিয়ে উঠতে পারিনি।”

এমন চিত্র শুধু নেত্রকোনা নয়, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, বরিশালের অনেক উপজেলাতেই দেখা গিয়েছিল। বেশিরভাগ ক্রেতা বলেছিলেন—দাম বেশি, আয় কম, তাই কম গরু কাটা ছাড়া উপায় ছিল না। অনেকে দুই পরিবার মিলে এক গরু কিনেছিলেন, কেউ আবার গরুর বদলে ছাগল বা ভেড়ার দিকেই ঝুঁকেছিলেন।

ছাগলের চাহিদা কিছুটা বেশি ছিল

এই বছর গরুর তুলনায় ছাগল বা ভেড়ার বিক্রি তুলনামূলক বেশি হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন অনেক হাট ব্যবসায়ী। যেমন, রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এক ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন, “মানুষ এবার বড় গরুর চিন্তা না করে ছোট প্রাণীর দিকেই গিয়েছিল। পাঁচ-ছয় হাজার টাকা বাজেটে ছাগল মিলেছে, যেটা দিয়ে কোরবানি দেওয়া গিয়েছিল আবার খরচও কম পড়েছিল।”

সাধারণ মানুষের কথায় উঠে এসেছিল, মাংসের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কোরবানির খরচ বহন করা এবার কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মূল্যস্ফীতি, সারের দাম, স্কুলের খরচ, ওষুধ-পত্র, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি—সব মিলিয়ে মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা ছিল না। ফলে ছাগল বা গরুর অংশীদারি ক্রয়ই হয়েছিল বাস্তবতা।

হাটের অর্থনীতি: ব্যবসায়ীদের ক্ষতির আশঙ্কা

খামারিরা যারা সারা বছর ধরে গরু পালন করেছিলেন, তাদের জন্য এবারের হাট মানে হয়েছিল শুধুই ক্ষতির হিসাব। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থেকে এক খামারি বলেছিলেন, “আমার তিনটা গরুর খোরাক, ভ্যাকসিন, বাড়ির খরচ চালিয়ে পুঁজি তুলে আনতেই হবে। কিন্তু এবার যে দাম বলছে, তাতে লোকসান ছাড়া উপায় নেই।”

অন্যদিকে অনেক ছোট খামারি যারা মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে গরু লালন করেছিলেন, তাদের জন্য অবস্থা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাটে বিক্রি না হলে সেই ঋণ মেটাতে হতো ধার করে বা জমি বিক্রি করে। ফলে ঈদের আনন্দ একরকম চাপায় পরিণত হয়েছিল খামারিদের জন্য।

কেনাকাটায় ছিল মিতব্যয়িতা

গ্রামে ঈদ মানেই জামা-কাপড়, জুতো, খেলনা, মুড়ি-মিষ্টির উৎসব। কিন্তু এবারের চিত্র ছিল আলাদা। ঈদের বাজারে মুদির দোকানদার, পোশাক বিক্রেতা, এমনকি হকাররাও জানিয়েছিলেন—ক্রেতা ছিল, কিন্তু কেনাকাটা ছিল সীমিত।

মাদারীপুরের শিবচরের এক দোকানি বলেছিলেন, “আগে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে সবাইর জন্য নতুন জামা নিতো। এবার শুধু বাচ্চাদের জন্য নিচ্ছে। তাও কম দামে।”

হাতের টানই ছিল এ বাস্তবতার কারণ। রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, স্থানীয় চাকরির সুযোগ কমে যাওয়া এবং আগাম মৌসুমি দুর্যোগের সম্ভাবনা—সব মিলিয়ে মানুষ আগেভাগেই সতর্ক হয়েছিল।

ধর্মীয় দায়িত্ব, সামাজিক বাস্তবতা

তবু কোরবানি দিতে হয়েছিল—এই ধর্মীয় দায়বদ্ধতার কারণেই অনেকে অল্প হলেও কোরবানি দিয়েছিলেন। কোথাও পাঁচজন মিলে একটি গরু, কোথাও বড় পরিবারের মধ্যে ছয়জন মিলে ছাগল কেটেছিলেন। সামাজিক চাহিদার চাপে অনেকে ধার করেও কোরবানি করেছিলেন, যাতে সামাজিকভাবে পিছিয়ে না পড়েন।

আনন্দ ছিল সীমিত, উৎসব ব্যক্তিগত

এবার গ্রামের ঈদের পরিবেশ ছিল তুলনামূলক কম চঞ্চল। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি হয়েছিল ঠিকই, তবে আত্মীয়তার বাড়ি যাওয়া, পাড়াপড়শিদের মাঝে বিতরণ, একত্রে রান্নাবান্না—এই চিত্রগুলো অনেক জায়গায় অনুপস্থিত ছিল।

পাবনার আটঘরিয়ার বাসিন্দা সাবিনা খাতুন বলেছিলেন, “আগে আমরা পাঁচ বাড়ি থেকে পাঁচ রকম মাংস এনে একসাথে রান্না করতাম। এবার সবাই নিজের গণ্ডিতেই থেকে গেছে। বলেছে, যা আছে তাতেই চলবে।”

ব্যয়বহুল ঈদের শীতল বাস্তবতা

২০২৫ সালের ঈদুল আজহার গ্রামীণ চিত্রে দেখা গিয়েছিল এক প্রকার অর্থনৈতিক সংকোচন। ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে গিয়ে মানুষ যথাসম্ভব হিসেবি হয়েছিল। কোরবানির পশুর সংখ্যায় ছিল ভাটা, ছাগলের বিক্রিতে কিছুটা স্বস্তি, পোশাক ও খাদ্যসামগ্রীর বাজারে ছিল ধীর গতি—সব মিলে এবারের ঈদ গ্রামীণ বাংলাদেশে এক শীতল বাস্তবতা উপস্থাপন করেছিল।

এ ছিল আনন্দের উৎসবে হিসাব-নিকাশের অংক, উৎসবের মাঝে টিকে থাকার লড়াই। তবে সবার একটাই প্রার্থনা ছিল—আগামী বছর যেন ঈদের হাসি আবারও ফিরে আসে সব বাড়িতে, সব উঠোনে।

গ্রামের ঈদে এবার কিছুটা ম্লান ছিলো হাসি

০৮:১২:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫

২০২৫ সালের ঈদুল আজহা সামনে রেখে দেশের গ্রামীণ হাটবাজারে যে কোরবানির গরু, ছাগল ও অন্যান্য সামগ্রীর কেনাবেচা হয়েছিল, সেখানে এবার এক ভিন্ন ধারা চোখে পড়েছিল। খামারিদের কণ্ঠে ছিল হতাশা, ক্রেতাদের চোখে ছিল হিসাব-নিকাশ আর বাজারে বিরাজ করেছিল অনিশ্চয়তা—সব মিলে এবারের ঈদের বাজার যেন আরেক রকমের বার্তা বহন করেছিল। অনেকেই বলেছিলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর গরু ও ছাগলের বিক্রি কমেছিল, সেই সঙ্গে ঈদের অন্যান্য কেনাকাটাতেও পড়েছিল প্রভাব।

গরুর হাটে ভিড়, কিন্তু বিক্রি কম

নেত্রকোনার কলমাকান্দার গরুর হাটে গত বছরের তুলনায় এ বছর মানুষ কম গরু কিনেছিল। হাটে গরু ছিল, মানুষও এসেছিল, দরাদরিও হয়েছিল; কিন্তু বিক্রি হয়েছিল অনেক কম। এক খামারি জানিয়েছিলেন, “গতবার একই সময়েই পাঁচটা গরু বিক্রি করেছিলাম, এবার তখনো দুইটার দামেই কুলিয়ে উঠতে পারিনি।”

এমন চিত্র শুধু নেত্রকোনা নয়, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, বরিশালের অনেক উপজেলাতেই দেখা গিয়েছিল। বেশিরভাগ ক্রেতা বলেছিলেন—দাম বেশি, আয় কম, তাই কম গরু কাটা ছাড়া উপায় ছিল না। অনেকে দুই পরিবার মিলে এক গরু কিনেছিলেন, কেউ আবার গরুর বদলে ছাগল বা ভেড়ার দিকেই ঝুঁকেছিলেন।

ছাগলের চাহিদা কিছুটা বেশি ছিল

এই বছর গরুর তুলনায় ছাগল বা ভেড়ার বিক্রি তুলনামূলক বেশি হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন অনেক হাট ব্যবসায়ী। যেমন, রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এক ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন, “মানুষ এবার বড় গরুর চিন্তা না করে ছোট প্রাণীর দিকেই গিয়েছিল। পাঁচ-ছয় হাজার টাকা বাজেটে ছাগল মিলেছে, যেটা দিয়ে কোরবানি দেওয়া গিয়েছিল আবার খরচও কম পড়েছিল।”

সাধারণ মানুষের কথায় উঠে এসেছিল, মাংসের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কোরবানির খরচ বহন করা এবার কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মূল্যস্ফীতি, সারের দাম, স্কুলের খরচ, ওষুধ-পত্র, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি—সব মিলিয়ে মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা ছিল না। ফলে ছাগল বা গরুর অংশীদারি ক্রয়ই হয়েছিল বাস্তবতা।

হাটের অর্থনীতি: ব্যবসায়ীদের ক্ষতির আশঙ্কা

খামারিরা যারা সারা বছর ধরে গরু পালন করেছিলেন, তাদের জন্য এবারের হাট মানে হয়েছিল শুধুই ক্ষতির হিসাব। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থেকে এক খামারি বলেছিলেন, “আমার তিনটা গরুর খোরাক, ভ্যাকসিন, বাড়ির খরচ চালিয়ে পুঁজি তুলে আনতেই হবে। কিন্তু এবার যে দাম বলছে, তাতে লোকসান ছাড়া উপায় নেই।”

অন্যদিকে অনেক ছোট খামারি যারা মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে গরু লালন করেছিলেন, তাদের জন্য অবস্থা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাটে বিক্রি না হলে সেই ঋণ মেটাতে হতো ধার করে বা জমি বিক্রি করে। ফলে ঈদের আনন্দ একরকম চাপায় পরিণত হয়েছিল খামারিদের জন্য।

কেনাকাটায় ছিল মিতব্যয়িতা

গ্রামে ঈদ মানেই জামা-কাপড়, জুতো, খেলনা, মুড়ি-মিষ্টির উৎসব। কিন্তু এবারের চিত্র ছিল আলাদা। ঈদের বাজারে মুদির দোকানদার, পোশাক বিক্রেতা, এমনকি হকাররাও জানিয়েছিলেন—ক্রেতা ছিল, কিন্তু কেনাকাটা ছিল সীমিত।

মাদারীপুরের শিবচরের এক দোকানি বলেছিলেন, “আগে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে সবাইর জন্য নতুন জামা নিতো। এবার শুধু বাচ্চাদের জন্য নিচ্ছে। তাও কম দামে।”

হাতের টানই ছিল এ বাস্তবতার কারণ। রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, স্থানীয় চাকরির সুযোগ কমে যাওয়া এবং আগাম মৌসুমি দুর্যোগের সম্ভাবনা—সব মিলিয়ে মানুষ আগেভাগেই সতর্ক হয়েছিল।

ধর্মীয় দায়িত্ব, সামাজিক বাস্তবতা

তবু কোরবানি দিতে হয়েছিল—এই ধর্মীয় দায়বদ্ধতার কারণেই অনেকে অল্প হলেও কোরবানি দিয়েছিলেন। কোথাও পাঁচজন মিলে একটি গরু, কোথাও বড় পরিবারের মধ্যে ছয়জন মিলে ছাগল কেটেছিলেন। সামাজিক চাহিদার চাপে অনেকে ধার করেও কোরবানি করেছিলেন, যাতে সামাজিকভাবে পিছিয়ে না পড়েন।

আনন্দ ছিল সীমিত, উৎসব ব্যক্তিগত

এবার গ্রামের ঈদের পরিবেশ ছিল তুলনামূলক কম চঞ্চল। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি হয়েছিল ঠিকই, তবে আত্মীয়তার বাড়ি যাওয়া, পাড়াপড়শিদের মাঝে বিতরণ, একত্রে রান্নাবান্না—এই চিত্রগুলো অনেক জায়গায় অনুপস্থিত ছিল।

পাবনার আটঘরিয়ার বাসিন্দা সাবিনা খাতুন বলেছিলেন, “আগে আমরা পাঁচ বাড়ি থেকে পাঁচ রকম মাংস এনে একসাথে রান্না করতাম। এবার সবাই নিজের গণ্ডিতেই থেকে গেছে। বলেছে, যা আছে তাতেই চলবে।”

ব্যয়বহুল ঈদের শীতল বাস্তবতা

২০২৫ সালের ঈদুল আজহার গ্রামীণ চিত্রে দেখা গিয়েছিল এক প্রকার অর্থনৈতিক সংকোচন। ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে গিয়ে মানুষ যথাসম্ভব হিসেবি হয়েছিল। কোরবানির পশুর সংখ্যায় ছিল ভাটা, ছাগলের বিক্রিতে কিছুটা স্বস্তি, পোশাক ও খাদ্যসামগ্রীর বাজারে ছিল ধীর গতি—সব মিলে এবারের ঈদ গ্রামীণ বাংলাদেশে এক শীতল বাস্তবতা উপস্থাপন করেছিল।

এ ছিল আনন্দের উৎসবে হিসাব-নিকাশের অংক, উৎসবের মাঝে টিকে থাকার লড়াই। তবে সবার একটাই প্রার্থনা ছিল—আগামী বছর যেন ঈদের হাসি আবারও ফিরে আসে সব বাড়িতে, সব উঠোনে।