০২:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

আসাম থেকে নতুন পদ্ধতিতে ‘পুশ ব্যাক’ হবে বাংলাদেশে?

  • Sarakhon Report
  • ০৮:১১:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫
  • 36

ভারতের আসাম রাজ্য থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে যে পুশ ব্যাক হচ্ছে, তা আরও বাড়বে এবং এর জন্য বহু পুরনো একটি আইনের খোঁজ তারা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।

ভারতের দিক থেকে কাউকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হলে সেটা ভারতের দিক থেকে পুশ ব্যাক আর একই ঘটনা বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে সেটা পুশ ইন।

ওই আইনটি ব্যবহার করা হলে সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে কোনও ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হবে না, সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের নির্দেশেই তাকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।

আইনজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ১৯৫০ সালে তৈরি ওই আইনটি নির্দিষ্ট কারণে আনা হয়েছিল। এই আইন দিয়ে ‘পুশ ব্যাক’ করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন গুয়াহাটি হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী।

তার কথায়, “বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলোকে এড়িয়ে এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে মানুষগুলোকে এখান থেকে পুশ ব্যাক করারই চেষ্টা করছেন সরকার। এটা করা যায় না।”

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা - ফাইল ছবিআসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা – ফাইল ছবি

নতুন পদ্ধতিতে ‘পুশ ব্যাক’ ?

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা জানিয়েছেন যে, ওই রাজ্য থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব মানুষকে ‘পুশ ব্যাক’ করে দেওয়া হচ্ছে, তার পদ্ধতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে তার সরকার।

তিনি বলেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কোনও বিদেশিকে চিহ্নিত বা প্রত্যর্পণ করতে প্রতিবার আদালতের অনুমোদন নিতে আসাম সরকার আইনত বাধ্য নয়। একটি পুরনো আইনি বিধি আছে – ‘অভিবাসী (আসাম থেকে বহিষ্কার) নির্দেশ, ১৯৫০’, এটা এখনও বলবত আছে।”

মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, এই আইন অনুযায়ী, জেলা কমিশনারদেরই অধিকার আছে আদালতে না গিয়েও বহিষ্কারের নির্দেশ দিতে পারেন, সেটা সুপ্রিম কোর্ট পুনর্ব্যক্ত করেছে।

“কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের আইনি পরামর্শদাতারা আগে এ ব্যাপারটা আমাদের জানান নি, আমরাও এটির ব্যবহারের সম্বন্ধে জানতাম না,” বলেছেন মি. বিশ্বশর্মা।

“এখন থেকে কাউকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হলে তাদের যে ট্রাইব্যুনালে পাঠাতেই হবে, তেমন নয়। যেসব মামলা কোনও আদালতে নেই, সেসব ক্ষেত্রে আমরা পুশ ব্যাক করে দেব। নতুন পদ্ধতিতে পুশ ব্যাকের জন্য গত কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি চলছে,” জানিয়েছেন মি. বিশ্বশর্মা।

তিনি এও বলছেন যে, ইতিমধ্যেই বেশ কিছু মানুষকে পুশ ব্যাক করা হয়েছে এবং চিহ্নিতকরণের তালিকা যত লম্বা হবে, ততই পুশ ব্যাক বাড়বে।

ভারত থেকে যাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদেরই একটি দল সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ডে কাটাতে বাধ্য হচ্ছেনভারত থেকে যাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদেরই একটি দল সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ডে কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন

কী আছে ৫০ সালের সেই আইনে?

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা যে পুরনো আইনটি এখন ব্যবহার করার কথা বলছেন, তা তৈরি করা হয়েছিল ১৯৫০ সালে পয়লা মার্চ।

ওই আইনটি বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার অনেক আগে পাকিস্তান আমলে তৈরি হয়েছিল। সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অভিবাসী (আসাম থেকে বহিষ্কার) নির্দেশ, ১৯৫০’।

আসাম থেকে বহিষ্কারের কথা বলা হলেও এই নির্দেশ পুরো ভারতেই বলবত করা যাবে বলে লেখা আছে আইনটিতে।

ভারতের বাইরের কোনও জায়গার নাগরিক যদি নির্দেশটি বলবত হওয়ার আগে বা পরে আসামে এসে থাকেন এবং যদি সেই ব্যক্তির আসামে বসবাস যদি ভারতের সাধারণ নাগরিকদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাহলে ভারত সরকারের কোনও অফিসার সেই ব্যক্তিকে নিজে থেকেই চলে যেতে বলতে পারেন অথবা তাকে ভারত থেকে বার করে দেওয়া হতে পারে।

কোন তারিখের মধ্যে এবং কোন পথ দিয়ে ফেরত যেতে হবে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে বহিষ্কারের নির্দেশে, লেখা আছে আইনটিতে।

ওই নির্দেশটি পাকিস্তানের আমলের, তাই সেখানে এও লেখা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তি যদি পাকিস্তানের সেই সব এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসামে এসে থাকেন যে এলাকায় অশান্তি হচ্ছে, বা অশান্তি হওয়ার আশঙ্কা আছে, তার ক্ষেত্রে এই নির্দেশ বলবত হবে না।

কেন্দ্রীয় সরকার বা আসাম মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের কোনও সরকারি অফিসার ওই নির্দেশ কার্যকর করতে পারবেন বলেও লেখা আছে আইনটিতে।

চিরাং জেলার এই দম্পতি বলছেন তারা ভারতীয়, কিন্তু তাদের ছেলেকে বাংলাদেশি বলে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ
চিরাং জেলার এই দম্পতি বলছেন তারা ভারতীয়, কিন্তু তাদের ছেলেকে বাংলাদেশি বলে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ

‘আইন ব্যবস্থাকে এড়ানোর চেষ্টা’?

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা যেভাবে ১৯৫০ সালের একটি আইন ব্যবহার করে পুশ ব্যাক করার কথা বলছেন, আইজীবীদের একাংশ মনে করছেন তা আসলে প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

গুয়াহাটি হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী বলছিলেন, “যে পুরনো আইনটি ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে, তা দিয়ে পুশ ব্যাক করাই যায় না। এটা নির্দিষ্ট ভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসামে আসা মানুষদের জন্য করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে যদি কারও অবস্থান ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাদের মধ্যে কেউ যদি ভারত বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকেন, তাহলেই তাকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।”

তিনি উল্লেখ করছিলেন যে, বারবার যে পুশ ব্যাক করার কথা বলা হচ্ছে, সেরকম পুশ ব্যাক যে আসামে ২০১৩ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা আসাম সরকারই হলফনামা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল।

“আসাম সরকার একটা এফিডেভিট জমা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালের একটি রিট পিটিশনে। সেখানে তারা বলেছিল যে, ২০১৩ সালের ১৩ই মার্চের পর থেকে আর কোনও পুশ ব্যাক তারা করে নি। যতজনকে বিদেশে ফেরানো হয়েছে, সবই প্রত্যর্পণের ঘটনা।”

“ট্রাইব্যুনালগুলোকে এড়িয়ে এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে এখান থেকে পুশ ব্যাক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলোকে এড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে তা না। ট্রাইব্যুনালের আদেশের পরে তো কেউ হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও যেতে পারেন আপিল করতে পারেন। এক্ষেত্রে পুরো বিচার ব্যবস্থাকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা অসাংবিধানিক,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।

ঘোষিত বাংলাদেশিদের আটক রাখার জন্য গোয়ালপাড়া জেলায় গড়া হয়েছে ভারতের  বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার
ঘোষিত বাংলাদেশিদের আটক রাখার জন্য গোয়ালপাড়া জেলায় গড়া হয়েছে ভারতের বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার

যাদের পুশ ব্যাক করা হচ্ছে, তারা কোন দেশের নাগরিক?

আসাম থেকে সম্প্রতি অনেক মানুষকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করা হয়েছে বলে সেখানকার মানবাধিকার সংগঠনগুলি যেমন জানাচ্ছে, তেমনই বিবিসির প্রতিনিধিরা এরকম বেশ কিছু পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছে, যাদের বাড়ির কোনও সদস্যকে পুশ ব্যাক করে দেওয়া হয়েছে।

মে মাসের ২৩ তারিখ থেকে এই বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।

এর আগে কখনও পুশ ব্যাক করার বিষয়টি ভারতের কোনও নিরাপত্তা এজেন্সিই স্বীকার করত না। কিন্তু সর্বশেষ অভিযান চালানোর পরে যে ‘ঘোষিত বিদেশি’দের পুশ ব্যাক করা হচ্ছে, তা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজেই।

মানবাধিকার সংগঠন সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস বা সিজেপি ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে এ নিয়ে পর পর দুটি অভিযোগ জমা দিয়েছে।

সংগঠনটি মুম্বাই ভিত্তিক হলেও তারা আসামে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে।

প্রথম অভিযোগে ওই সংগঠনটি জানিয়েছিল যে তিনশোরও বেশি মানুষকে প্রথম দফায় আটক করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রায় দেড়শো মানুষ ফিরে এসেছেন তাদের বাড়িতে।

কিন্তু আটক করে নিয়ে যাওয়ার দশ দিন পর পর্যন্তও ১৪৫ জনের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি।

যাদের আটক করে পুশ ব্যাক করে দেওয়া হয়েছিল, এরকম ছয়জন নারী পুরুষের সঙ্গে সিজেপি সরাসরি কথা বলেছে এবং আরও পাঁচ জনের ঘটনা তারা কিছু ‘বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম’ থেকে পেয়েছে বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে পাঠানো দ্বিতীয় অভিযোগে জানিয়েছে সিজেপি।

সংগঠনটির আসাম রাজ্য ইনচার্জ পারিজাত নন্দ ঘোষ জানাচ্ছেন যে, প্রতিটা ঘটনাতেই মাঝরাতে কোনও ওয়ারেন্ট বা অন্য কোনও নথি ছাড়াই আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে গোপনে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপরে সীমান্ত এলাকায় বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে ছেড়ে দিয়ে আসছে বলে জানানো হয়েছে অভিযোগ জানিয়েছে ওই সংগঠনটি।

ওই সংগঠনটি বলছে, যেভাবে মানুষকে বাংলাদেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এটাকে তারা ‘পুশ ব্যাক’ নয়, ‘পুশ আউট’ বলে অভিহিত করতে চান।

সিজেপির রাজ্য ইনচার্জ পারিজাত নন্দ ঘোষ বলছিলেন, “এই যেভাবে পুশ আউট করা হচ্ছে, এটা তো অমানবিক ব্যাপার হচ্ছে। যাদের আটক করা হচ্ছে, তাদেরকে না হয় বিদেশি ট্রাইব্যুনাল থেকে বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু তারা কোন দেশের নাগরিক সেটা তো নিশ্চিত নয়। তাহলে কেন পুশ আউট করে দেওয়া হচ্ছে!

“আবার আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে পরিবারকে কেন জানানো হচ্ছে না যে তাদের কোথায় কীভাবে রাখা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী তো এটা পরিবারকে জানানোর কথা,” বলছিলেন মি. ঘোষ।

বিবিসি বাংলা

আসাম থেকে নতুন পদ্ধতিতে ‘পুশ ব্যাক’ হবে বাংলাদেশে?

০৮:১১:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০২৫

ভারতের আসাম রাজ্য থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে যে পুশ ব্যাক হচ্ছে, তা আরও বাড়বে এবং এর জন্য বহু পুরনো একটি আইনের খোঁজ তারা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।

ভারতের দিক থেকে কাউকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হলে সেটা ভারতের দিক থেকে পুশ ব্যাক আর একই ঘটনা বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে সেটা পুশ ইন।

ওই আইনটি ব্যবহার করা হলে সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে কোনও ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হবে না, সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের নির্দেশেই তাকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।

আইনজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ১৯৫০ সালে তৈরি ওই আইনটি নির্দিষ্ট কারণে আনা হয়েছিল। এই আইন দিয়ে ‘পুশ ব্যাক’ করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন গুয়াহাটি হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী।

তার কথায়, “বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলোকে এড়িয়ে এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে মানুষগুলোকে এখান থেকে পুশ ব্যাক করারই চেষ্টা করছেন সরকার। এটা করা যায় না।”

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা - ফাইল ছবিআসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা – ফাইল ছবি

নতুন পদ্ধতিতে ‘পুশ ব্যাক’ ?

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা জানিয়েছেন যে, ওই রাজ্য থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব মানুষকে ‘পুশ ব্যাক’ করে দেওয়া হচ্ছে, তার পদ্ধতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে তার সরকার।

তিনি বলেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কোনও বিদেশিকে চিহ্নিত বা প্রত্যর্পণ করতে প্রতিবার আদালতের অনুমোদন নিতে আসাম সরকার আইনত বাধ্য নয়। একটি পুরনো আইনি বিধি আছে – ‘অভিবাসী (আসাম থেকে বহিষ্কার) নির্দেশ, ১৯৫০’, এটা এখনও বলবত আছে।”

মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, এই আইন অনুযায়ী, জেলা কমিশনারদেরই অধিকার আছে আদালতে না গিয়েও বহিষ্কারের নির্দেশ দিতে পারেন, সেটা সুপ্রিম কোর্ট পুনর্ব্যক্ত করেছে।

“কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের আইনি পরামর্শদাতারা আগে এ ব্যাপারটা আমাদের জানান নি, আমরাও এটির ব্যবহারের সম্বন্ধে জানতাম না,” বলেছেন মি. বিশ্বশর্মা।

“এখন থেকে কাউকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হলে তাদের যে ট্রাইব্যুনালে পাঠাতেই হবে, তেমন নয়। যেসব মামলা কোনও আদালতে নেই, সেসব ক্ষেত্রে আমরা পুশ ব্যাক করে দেব। নতুন পদ্ধতিতে পুশ ব্যাকের জন্য গত কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি চলছে,” জানিয়েছেন মি. বিশ্বশর্মা।

তিনি এও বলছেন যে, ইতিমধ্যেই বেশ কিছু মানুষকে পুশ ব্যাক করা হয়েছে এবং চিহ্নিতকরণের তালিকা যত লম্বা হবে, ততই পুশ ব্যাক বাড়বে।

ভারত থেকে যাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদেরই একটি দল সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ডে কাটাতে বাধ্য হচ্ছেনভারত থেকে যাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদেরই একটি দল সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ডে কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন

কী আছে ৫০ সালের সেই আইনে?

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা যে পুরনো আইনটি এখন ব্যবহার করার কথা বলছেন, তা তৈরি করা হয়েছিল ১৯৫০ সালে পয়লা মার্চ।

ওই আইনটি বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার অনেক আগে পাকিস্তান আমলে তৈরি হয়েছিল। সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অভিবাসী (আসাম থেকে বহিষ্কার) নির্দেশ, ১৯৫০’।

আসাম থেকে বহিষ্কারের কথা বলা হলেও এই নির্দেশ পুরো ভারতেই বলবত করা যাবে বলে লেখা আছে আইনটিতে।

ভারতের বাইরের কোনও জায়গার নাগরিক যদি নির্দেশটি বলবত হওয়ার আগে বা পরে আসামে এসে থাকেন এবং যদি সেই ব্যক্তির আসামে বসবাস যদি ভারতের সাধারণ নাগরিকদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাহলে ভারত সরকারের কোনও অফিসার সেই ব্যক্তিকে নিজে থেকেই চলে যেতে বলতে পারেন অথবা তাকে ভারত থেকে বার করে দেওয়া হতে পারে।

কোন তারিখের মধ্যে এবং কোন পথ দিয়ে ফেরত যেতে হবে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে বহিষ্কারের নির্দেশে, লেখা আছে আইনটিতে।

ওই নির্দেশটি পাকিস্তানের আমলের, তাই সেখানে এও লেখা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তি যদি পাকিস্তানের সেই সব এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসামে এসে থাকেন যে এলাকায় অশান্তি হচ্ছে, বা অশান্তি হওয়ার আশঙ্কা আছে, তার ক্ষেত্রে এই নির্দেশ বলবত হবে না।

কেন্দ্রীয় সরকার বা আসাম মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের কোনও সরকারি অফিসার ওই নির্দেশ কার্যকর করতে পারবেন বলেও লেখা আছে আইনটিতে।

চিরাং জেলার এই দম্পতি বলছেন তারা ভারতীয়, কিন্তু তাদের ছেলেকে বাংলাদেশি বলে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ
চিরাং জেলার এই দম্পতি বলছেন তারা ভারতীয়, কিন্তু তাদের ছেলেকে বাংলাদেশি বলে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ

‘আইন ব্যবস্থাকে এড়ানোর চেষ্টা’?

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা যেভাবে ১৯৫০ সালের একটি আইন ব্যবহার করে পুশ ব্যাক করার কথা বলছেন, আইজীবীদের একাংশ মনে করছেন তা আসলে প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

গুয়াহাটি হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী বলছিলেন, “যে পুরনো আইনটি ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে, তা দিয়ে পুশ ব্যাক করাই যায় না। এটা নির্দিষ্ট ভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসামে আসা মানুষদের জন্য করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে যদি কারও অবস্থান ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাদের মধ্যে কেউ যদি ভারত বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকেন, তাহলেই তাকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।”

তিনি উল্লেখ করছিলেন যে, বারবার যে পুশ ব্যাক করার কথা বলা হচ্ছে, সেরকম পুশ ব্যাক যে আসামে ২০১৩ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা আসাম সরকারই হলফনামা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল।

“আসাম সরকার একটা এফিডেভিট জমা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালের একটি রিট পিটিশনে। সেখানে তারা বলেছিল যে, ২০১৩ সালের ১৩ই মার্চের পর থেকে আর কোনও পুশ ব্যাক তারা করে নি। যতজনকে বিদেশে ফেরানো হয়েছে, সবই প্রত্যর্পণের ঘটনা।”

“ট্রাইব্যুনালগুলোকে এড়িয়ে এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে এখান থেকে পুশ ব্যাক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলোকে এড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে তা না। ট্রাইব্যুনালের আদেশের পরে তো কেউ হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও যেতে পারেন আপিল করতে পারেন। এক্ষেত্রে পুরো বিচার ব্যবস্থাকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা অসাংবিধানিক,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।

ঘোষিত বাংলাদেশিদের আটক রাখার জন্য গোয়ালপাড়া জেলায় গড়া হয়েছে ভারতের  বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার
ঘোষিত বাংলাদেশিদের আটক রাখার জন্য গোয়ালপাড়া জেলায় গড়া হয়েছে ভারতের বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার

যাদের পুশ ব্যাক করা হচ্ছে, তারা কোন দেশের নাগরিক?

আসাম থেকে সম্প্রতি অনেক মানুষকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করা হয়েছে বলে সেখানকার মানবাধিকার সংগঠনগুলি যেমন জানাচ্ছে, তেমনই বিবিসির প্রতিনিধিরা এরকম বেশ কিছু পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছে, যাদের বাড়ির কোনও সদস্যকে পুশ ব্যাক করে দেওয়া হয়েছে।

মে মাসের ২৩ তারিখ থেকে এই বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।

এর আগে কখনও পুশ ব্যাক করার বিষয়টি ভারতের কোনও নিরাপত্তা এজেন্সিই স্বীকার করত না। কিন্তু সর্বশেষ অভিযান চালানোর পরে যে ‘ঘোষিত বিদেশি’দের পুশ ব্যাক করা হচ্ছে, তা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজেই।

মানবাধিকার সংগঠন সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস বা সিজেপি ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে এ নিয়ে পর পর দুটি অভিযোগ জমা দিয়েছে।

সংগঠনটি মুম্বাই ভিত্তিক হলেও তারা আসামে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে।

প্রথম অভিযোগে ওই সংগঠনটি জানিয়েছিল যে তিনশোরও বেশি মানুষকে প্রথম দফায় আটক করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রায় দেড়শো মানুষ ফিরে এসেছেন তাদের বাড়িতে।

কিন্তু আটক করে নিয়ে যাওয়ার দশ দিন পর পর্যন্তও ১৪৫ জনের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি।

যাদের আটক করে পুশ ব্যাক করে দেওয়া হয়েছিল, এরকম ছয়জন নারী পুরুষের সঙ্গে সিজেপি সরাসরি কথা বলেছে এবং আরও পাঁচ জনের ঘটনা তারা কিছু ‘বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম’ থেকে পেয়েছে বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে পাঠানো দ্বিতীয় অভিযোগে জানিয়েছে সিজেপি।

সংগঠনটির আসাম রাজ্য ইনচার্জ পারিজাত নন্দ ঘোষ জানাচ্ছেন যে, প্রতিটা ঘটনাতেই মাঝরাতে কোনও ওয়ারেন্ট বা অন্য কোনও নথি ছাড়াই আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে গোপনে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপরে সীমান্ত এলাকায় বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে ছেড়ে দিয়ে আসছে বলে জানানো হয়েছে অভিযোগ জানিয়েছে ওই সংগঠনটি।

ওই সংগঠনটি বলছে, যেভাবে মানুষকে বাংলাদেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এটাকে তারা ‘পুশ ব্যাক’ নয়, ‘পুশ আউট’ বলে অভিহিত করতে চান।

সিজেপির রাজ্য ইনচার্জ পারিজাত নন্দ ঘোষ বলছিলেন, “এই যেভাবে পুশ আউট করা হচ্ছে, এটা তো অমানবিক ব্যাপার হচ্ছে। যাদের আটক করা হচ্ছে, তাদেরকে না হয় বিদেশি ট্রাইব্যুনাল থেকে বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু তারা কোন দেশের নাগরিক সেটা তো নিশ্চিত নয়। তাহলে কেন পুশ আউট করে দেওয়া হচ্ছে!

“আবার আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে পরিবারকে কেন জানানো হচ্ছে না যে তাদের কোথায় কীভাবে রাখা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী তো এটা পরিবারকে জানানোর কথা,” বলছিলেন মি. ঘোষ।

বিবিসি বাংলা