ট্রাম্পের স্বপ্ন: উৎপাদন ফিরিয়ে আনা আমেরিকায়
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে শুল্ক আরোপ করে ঘোষণা দেন—বিদেশি পণ্যে কর বসিয়ে দেশীয় কর্মসংস্থান ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনায় সন্দিহান অনেক শিল্পপ্রধান।
লস অ্যাঞ্জেলেসে ‘সাইটেক্স’ নামের একটি ফ্যাক্টরির প্রধান সঞ্জীব বাহলের মতে, আমেরিকাও আবার উৎপাদনে ফিরতে পারে। তার কারখানায় প্রতি মাসে ৭০ হাজার জিন্স তৈরি হয় এবং প্রায় ২৫০ জন কর্মী কাজ করেন। এই পোশাকগুলো ‘এভারলেন’, ‘জে. ক্রু’ এবং ‘রালফ লরেন’-এর মতো ব্র্যান্ডে যায়।
আসল বাস্তবতা: ভিয়েতনামের উপর নির্ভরতা
তবে বাস্তবে বাহলের ব্যবসার বড় অংশ নির্ভর করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের একটি বিশাল ফ্যাক্টরির ওপর, যেখানে ৫ লাখ জিন্স তৈরি হয় মাসে, আর কাজ করেন হাজার হাজার শ্রমিক। আমেরিকার নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থায় এখনও ঘাটতি রয়ে গেছে—যেমন দক্ষ শ্রমিক, প্রশিক্ষণব্যবস্থা, প্রযুক্তি ও সরকারি সহায়তা।
বাধা একাধিক: আদালত, নীতি আর বাস্তবতা
ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত নতুন ৪৬ শতাংশ শুল্ক ভিয়েতনামসহ পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই শুল্ককে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত বেআইনি বললেও, আপিলের কারণে তা আপাতত স্থগিত।
এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার বলেন, ‘আমরা স্নিকার্স আর টি-শার্ট তৈরি করতেই চাই না।’ ফলে এই নীতিতে বিভ্রান্তি ও দ্বৈততা স্পষ্ট।
কোভিডের ধাক্কা ও নতুন চ্যালেঞ্জ
কোভিড মহামারির সময় এশিয়ার কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আমেরিকান কোম্পানিগুলো বুঝতে পারে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বিদেশনির্ভরতা।
এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাহল ২০২১ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে কারখানা চালু করেন। এখন তার লক্ষ্য—কারখানার উৎপাদনের ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা, যদিও বর্তমানে তা ১০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা
সাইটেক্সের মডেল হয়তো অনুপ্রেরণাদায়ক, তবে বাস্তবে তা বড় পরিসরে কার্যকর নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদন হয় না, বড় মাপের সুতা বা বোতাম তৈরির মিল নেই। শ্রমিকও কম। ওয়েলস ফারগোর অর্থনীতিবিদদের হিসাব মতে, উৎপাদনখাতকে ১৯৭০ দশকের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে নতুন ২ কোটি ২০ লাখ শ্রমিক লাগবে, অথচ বেকার মাত্র ৭২ লাখ।
ইমিগ্রেশন হ্রাসের প্রভাব
ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী নীতিও শ্রমিক সংকটকে আরও তীব্র করেছে। ভিয়েতনামের মতো দেশে তরুণ শ্রমিক সহজে মেলে, যাঁরা দারিদ্র্য থেকে উঠে আসতে চান। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের শ্রমিক কম।
“রোমান্টিক চিন্তা” বনাম বাস্তবতা
আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান স্টিভ লামার বলেন, “অনেকে বলেন দেশে পোশাক তৈরি করা উচিত, কিন্তু নিজেরা বা সন্তানদের কেউই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে চায় না।”
লস অ্যাঞ্জেলেসের সাইটেক্স কারখানার শ্রমিকদের অধিকাংশই মেক্সিকো, গুয়াতেমালা এবং এল সালভাদর থেকে আসা অভিবাসী।
দামের ফারাক ও প্রযুক্তিগত পার্থক্য
একজন সেলাই শ্রমিককে ভিয়েতনামে মাসে ৫০০ ডলার দেওয়া হয়, আর লস অ্যাঞ্জেলেসে একই কাজের জন্য দিতে হয় ৪,০০০ ডলার। ডং নাই প্রদেশে সাইটেক্সের কারখানায় অটোমেশনের মাধ্যমে একসঙ্গে এক ডজন পোশাকে লেবেল লাগানো হয় কিংবা রোবটিক যন্ত্র দিয়ে জিন্সে ডিজাইন স্প্রে করা হয়।
‘মেইড ইন ইউএসএ’ স্বপ্নের বাস্তবায়ন কত দূরে?
বাহলের মতে, আমেরিকায় উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে হলে এমন কোম্পানিকে শুল্ক ছাড় দিতে হবে যারা দেশে বিনিয়োগ করছে। কারণ এখনো পর্যন্ত কাপড়, বোতাম, চেইন সবই আমদানি করতে হয়।
ভিয়েতনামে তার কারখানায় এখন পর্যন্ত ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। সেখানে ৯৮ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহার হয়, বাতাসে কার্বন নিঃসরণ কমানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলার।
শেষ কথা: ট্রাম্পের শুল্ক থাকলে আমেরিকান কারখানার ভবিষ্যত অনিশ্চিত
যদি ট্রাম্প তার ৪৬ শতাংশ শুল্ক থেকে সরে না আসেন এবং সাইটেক্স সেই ধাক্কা সামাল দিতে না পারে, তাহলে বাহল ভিয়েতনামে তৈরি পণ্য ইউরোপে পাঠানোর কথা ভাববেন। কারণ ইতোমধ্যে ইউরোপে তারা তৈরি পোশাকের অর্ধেক রপ্তানি করছে।
কিন্তু বাহল প্রশ্ন তোলেন—“তাহলে আমাদের আমেরিকান কারখানার ভবিষ্যত কী?”
সারাংশ:
‘মেইড ইন আমেরিকা’ একটি আদর্শিক স্বপ্ন হলেও বাস্তবতা বলছে—যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি কাজ। এর জন্য চাই প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, শ্রমিক এবং সরকারের সুসংগঠিত পরিকল্পনা—যা এখনো অনুপস্থিত।
‘মেইড ইন আমেরিকা’ স্বপ্নের বাস্তবতা
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট
- ১২:৩২:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
- 59
জনপ্রিয় সংবাদ