রাত দশটায়ও তেজগাঁও শিল্প এলাকার ছোট্ট বাসায় আলো জ্বলছে। অফিস থেকে ফিরেই নীল রঙের এক্সেল শিট খুলে বসেছেন আশরাফুল ইসলাম (৩৪)। গত জুলাই থেকে বেতন বাড়েনি; তবু নতুন বাজেটে আয়কর স্ল্যাব বদলানোয় বাড়তি তিন হাজার টাকার কর কেটে যাবে—এই হিসাব মিলিয়ে ঘাম জমেছে কপালে। “বাচ্চার স্কুল ফি, বাজার খরচ, মোবাইল কিস্তি… সব তো আগেরই,” বলেন আশরাফুল, “কিন্তু এবার মাসের ২৫ তারিখেই হাত খালি হয়ে যেতে পারে।”
শুধু আশরাফুল নন। গার্মেন্টস–কর্মী ফরিদা বেগম বেতন পান বারো হাজার টাকা, যার বেশিরভাগই খরচ হয়ে যায় চাল–ডাল আর বাসা–ভাড়ায়। বাজারে এক কেজি পিয়াজ ৮০ টাকা ছুঁইছুঁই। তিনি ক্ষীণ হাসিতে বললেন, “বাজেট শুনি, কিন্তু আমাদের পকেটের বাজেটই তো কালো হয়ে যাচ্ছে।”
বাজেটের অংক, বাস্তবতার আঁচ
অস্থায়ী সরকারের ৭.৯০ লাখ কোটি টাকার ২০২৫–২৬ বাজেটকে তার নির্মাতারাই ‘সংকোচনমূলক’ বলছেন। লক্ষ্য: ঘাটতি জিডিপির ৩.৬ শতাংশে বেঁধে রাখা। কিন্তু এই বাধা মানতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা—সব বরাদ্দই কার্যত স্তব্ধ।
- মূল্যস্ফীতি বাজেটপত্রে ৬.৫ শতাংশে নামানোর স্বপ্ন, অথচ সরকারি পরিসংখ্যানেই এপ্রিল পর্যন্ত গড় ৯ শতাংশের ওপরে।
- আয়করের কর-মুক্ত সীমা তিন বছর ধরে ৩.৫ লাখ টাকাতেই আটকে আছে; নতুন স্ল্যাব কাঠামোয় করের হার বেড়েছে, ফলে মধ্যবিত্ত বেতনভোগীরা সরাসরি টান অনুভব করবেন।
- ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক বেড়েছে প্লাস্টিক গৃহস্থালি সামগ্রী, মোবাইল ফোন, রান্নাঘরের সরঞ্জাম, এমনকি দরিদ্র মানুষের ভরসা সস্তা সয়াবিন তেলেও।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ ড. সালমা বেগ মনে করেন, “এই বাজেটে রাজস্ব বাড়াতে যা করা হয়েছে, তা আসলে পরোক্ষ করের মাধ্যমে নিম্ন–মধ্যবিত্তের ঘাড়েই চাপবে। সরাসরি করের ক্ষেত্রেও করমুক্ত সীমা না বাড়ানো বড় আঘাত।”
বিদ্যুতের আলো, বিলের শঙ্কা
কাগজে–কলমে বিদ্যুতের দাম স্থির। তবু ভর্তুকি ৩৭,০০০ কোটি টাকা থেকে ৩,৭০০ কোটি টাকায় নামাতে সরকারের ‘কস্ট কাট’ নির্দেশনা। উৎপাদন–খরচ ১০ শতাংশ কমানো না গেলে শীতে আবারও ইউনিট–দর বাড়ার আশঙ্কা প্রবল।
নরসিংদীর তাঁত ব্যবসায়ী সুকুমার সাহা বলেন, “ইয়ার্নের দাম বেড়েছে, গ্যাসের বিল বেড়েছে; এখন বিদ্যুৎ বাড়লে তাঁত ঘোরানোই অসম্ভব হবে। কারখানায় গিয়ে কী বলব শ্রমিকদের?”
চাকরি–বাজারের মেঘলা আকাশ
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ জানাচ্ছে, তরুণ বেকারের সংখ্যা ৩২ লাখে দাঁড়িয়েছে—গত পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ। বিনিয়োগ কম, ব্যাংক ঋণে সুদ বাড়ায় নতুন শিল্প কারখানা স্থগিত। ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণেরা ঝুলে থাকছেন ‘চাকরি পাব তো?’ দোলনায়; আর যাঁরা আছেন, তাঁদের মজুরি বাড়েনি দু–তিন বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. জাহিদ হোসেন বললেন, “মজুরি স্থবির, মূল্যস্ফীতি চড়া, আর কর অর্থ কেটে নিচ্ছে ইয়াবহখানি। এটা মধ্যবিত্তের ট্রিপল হিট।”
অপরিকল্পিত কর-কাঠামো: কুমিরের গর্ভ
কর সারচার্জের লক্ষ্য উচ্চবিত্ত—কাগজে–কলমে। বাস্তবে নিজের মিরপুরের ফ্ল্যাট আর বগুড়ার দুই বিঘা উত্তরাধিকারী জমি বাবদ ‘সম্পদ কর’ দিতে হবে মেডিকেল–এইড কোম্পানির ব্র্যান্ড ম্যানেজার সামিনা সুলতানাকে। “এগুলো বেচবো? নাকি বেতন থেকে কেটে নিয়ে যাব? সন্তান পড়ছে কলেজে,” সামিনা আক্ষেপ করেন। করবস্তুকে ‘লাক্সারি’ ধরে সারচার্জ বসানোর ফলে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় ভাঙার আশঙ্কা বাড়ছে।
অন্ধকার কেন ঘনাবে?
একদিকে আয়ের স্থবিরতা, অন্যদিকে খরচের বিস্তার। গড় মধ্যবিত্ত পরিবার যেখানে মাসিক ব্যয়ের ৪৫ শতাংশ খরচ করে খাদ্যে, সেখানে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল—সবকিছুর দাম বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ১২–১৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়–হার দুই বছরের মধ্যে ১০ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৬ শতাংশে।
সমাজবিজ্ঞানী ড. শামীমা করিমের ভাষায়, “মজুরি অবৈষম্য কমাতে রাষ্ট্রকে ন্যূনতম মজুরি সমন্বয় করতে হয়। কিন্তু বাজেটে সে পদক্ষেপ নেই। ফলে নিম্নবিত্ত পরিবারকে হয় কম খেতে, নয় ধার করতে হবে।”
কী করে দাঁড়াবেন সাধারণ মানুষ?
অগ্রাধিকার তালিকা করে খরচ করুন—খরচের তালিকায় ‘চাওয়া’ আর ‘প্রয়োজন’-এর ভেদ করুন।
আয়ের বিকল্প উৎস—ফ্রি-ল্যান্সিং, অনলাইন বিক্রয়, গ্রামীণ কৃষি–প্রকল্পের দিকে তাকান।
অর্থনৈতিক পড়াশোনা করুন—ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনার কর্মশালা বা অনলাইন কোর্সে অংশ নিন।
সমাজ–পেশাজীবী জোট গড়ে তুলুন—করমুক্ত সীমা বাড়ানো, ন্যূনতম মজুরি সমন্বয়ের দাবিতে একসঙ্গে আওয়াজ তুলুন।
বাজেট যে কাগজে–কলমে সংকুচিত, তা নয়; সেটি সংকুচিত করেছে স্বপ্ন ও সুরক্ষার বলয়। মানুষ এখন হিসাব কষছে—ইলেকট্রনিকস কিনবে না বাচ্চার কোচিং ফি দেবে? বারান্দার টবের সব্জি কি মাসের শেষ দুই দিন বাঁচাবে? দ্রব্যমূল্যের বাঁধ না ভাঙলে, আর প্রতিশ্রুত সামাজিক সুরক্ষা না বাড়লে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নিচে যে পলকা ভূমি আছে, তার ফাটল আরও চওড়া হবে।
অন্ধকারটা নিছক আর্থিক নয়—এটি ভর করে স্বপ্নহীনতার ঘন ছায়ায়, যেখানে ভবিষ্যৎ আলো শুধু তখনই জ্বলে, যখন একটা ব্যয়ে কাটছাঁট করে আরেকটি স্বপ্নকে বাঁচিয়ে নেওয়া যায়।