শীতলক্ষ্যার পরিচয়: ঢাকার প্রাণরেখা
শীতলক্ষ্যা নদী, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর একটি শাখা, ঢাকার পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নারায়ণগঞ্জের মধ্য দিয়ে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এক সময় এই নদী ঢাকাকে যুক্ত করেছিল উপনিবেশিক রাজধানী কলকাতা, দক্ষিণ বঙ্গের বাণিজ্য কেন্দ্র বরিশাল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গে। শীতলক্ষ্যার ইতিহাস মানেই এক নদীর বহুমুখী রূপ—পরিবহন, বাণিজ্য, জীবিকা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের গল্প।
ব্রিটিশ আমলে শীতলক্ষ্যার গুরুত্ব: পাটের রাজনীতি ও নদীঘাট
ঊনিশ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশরা যখন পূর্ববঙ্গে রেললাইনের পাশাপাশি নদীপথ উন্নয়নে মনোযোগ দেয়, তখন শীতলক্ষ্যা ছিল তাদের মূল ভরসার পথ। পাটশিল্পের বিকাশে এই নদী হয়ে উঠেছিল “পাটবাহী জলরথ”। কলকাতার ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি ও রিভার স্টিমার সার্ভিস নিয়মিত স্টিমার চালাত নারায়ণগঞ্জ-কলকাতা রুটে।
ড. আবদুল করিমের বাংলাদেশের নদী বাণিজ্য গ্রন্থে বলা হয়েছে, “১৯২০-এর দশকে শীতলক্ষ্যার তীরেই পূর্ববঙ্গের সর্ববৃহৎ পাটঘাট গড়ে ওঠে; কলকাতা বন্দরে রপ্তানির ৪০% পাট এই নদীপথ দিয়ে পরিবাহিত হতো।”
নারায়ণগঞ্জ, বন্দরের কাঁচপুর, চৌধুরীপাড়া, গুদারাঘাট—এসব জায়গায় গড়ে ওঠে কাঠের জেটি, স্টিমার টার্মিনাল, শুল্ক অফিস ও গুদাম। নারায়ণগঞ্জ রিভার পোর্ট তখন ভারতের অন্যতম ব্যস্ত নদীবন্দরে পরিণত হয়।
আধুনিক যোগাযোগ ও “স্টিমার লাইফ”
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ ও আসামকে আলাদা প্রদেশ ঘোষণা করলে পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কার্যক্রমে ঢাকার গুরুত্ব বাড়ে। এই সময় শীতলক্ষ্যা হয়ে ওঠে “অফিসিয়াল কমিউনিকেশন চ্যানেল”। রাজকর্মচারী, ইউরোপীয় ব্যবসায়ী, কাগজপত্র, সরকারি তহবিল—সব চলত স্টিমারে।
সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ড. তারেক হোসেন বলেন,
“আমার দাদার বর্ণনায় শুনেছি, শুক্রবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতাগামী স্টিমারে বসত কলকাতার অফিসাররা, সঙ্গে থাকত ব্যান্ড পারফর্মার, বাবুর্চি, আর পাটগাঁঠার চালান।”
স্টিমারে যাত্রীদের জন্য ছিল তিনটি শ্রেণি—ইউরোপীয়, জমিদার/সাহেব শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষ। স্টিমার কোম্পানির পুরোনো বিজ্ঞাপনপত্রে উল্লেখ আছে, ঢাকা-কলকাতা যাত্রা হতো তিন দিনে।
শীতলক্ষ্যার নদীবন্দরের চরিত্র
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা-ঢাকা সরাসরি নৌপথ বন্ধ হয়ে গেলেও নারায়ণগঞ্জ বন্দরের গুরুত্ব কমেনি। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা যখন পাটশিল্পের রাজধানীতে পরিণত হয়, তখন শীতলক্ষ্যা হয়ে ওঠে এই শিল্পের রক্তধারা।
নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠে সোনালী পাট শিল্প। আদমজী জুট মিল ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল, যার মালামাল পরিবহন হতো এই নদীতেই। নারায়ণগঞ্জ রিভার পোর্ট থেকে ১৯৭০ সালে দৈনিক গড়ে ৬০০ পণ্যবাহী নৌযান যেত চট্টগ্রাম, বরিশাল, মংলা ও চাঁদপুর।
নদীর মাছ ও জীববৈচিত্র্য
শীতলক্ষ্যার জল ছিল এক সময়ে সুপেয় এবং মাছভরা। ১৯৫০-৬০-এর দশকে চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, শোল, টেংরা, পাবদা, গুঁটি—এইসব মাছ এত বেশি পরিমাণে পাওয়া যেত যে, স্থানীয় জেলেরা বছরে তিনবার উৎসব করত।
রূপগঞ্জের প্রবীণ জেলে আব্দুল খালেক বলেন,
“আমরা এক রাতে ২০-২৫ কেজি বোয়াল তুলতাম। গুঁটি মাছ নদীতে এমনভাবে ঝাঁক করে চলত যে নৌকায় উঠে আসত।”
এছাড়াও নদীতে ছিল প্রচুর জলজ উদ্ভিদ ও পাখি। বর্ষায় নদী ফুলে উঠলে ঢাকার মানুষ শীতলক্ষ্যা পাড়ে ভ্রমণে আসত। সেই সময় এটি ছিল এক প্রাকৃতিক বিনোদনস্থলও।
স্বাধীন বাংলাদেশে নদীর ব্যবহার
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর নারায়ণগঞ্জ বন্দরের গুরুত্ব আরও বাড়ে। আদমজী জুট মিল, কর্ণফুলী পেপার মিল, ঢাকার বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার পণ্য এই নদীপথেই পরিবাহিত হতো। ১৯৮০-এর দশকেও শীতলক্ষ্যায় দিনে গড়ে ৩০০-৪০০ ট্রলার চলত।
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) শীতলক্ষ্যাকে “জাতীয় বাণিজ্যিক নদীপথ” হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
নদীর বর্তমান সংকট
১৯৯০-এর দশক থেকে নদীর সৌন্দর্য আর কার্যকারিতা কমতে শুরু করে। শিল্পবর্জ্য, ট্যানারি, ডাইং কারখানা, অবৈধ দখল ও নদী ভরাট—সব মিলে নদীটির গতিপথ ও স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শরিফা সুলতানা বলেন,
“শীতলক্ষ্যার পানিতে এখন অক্সিজেন মাত্রা এতটাই কম যে, অধিকাংশ মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এটি এখন একটা মৃতপ্রায় নদী।”
২০০০ সালের পর নদীঘাটগুলোও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যায়। বহু জায়গায় নদীর তলদেশ ভরাট করে গড়ে তোলা হয় বাজার, আবাসন প্রকল্প, শিপইয়ার্ড।
৭. নদী বাঁচাতে করণীয়
নদী বাঁচাতে হলে চাই সমন্বিত উদ্যোগ:
- শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা:প্রতিটি কারখানায় ইটিপি (Effluent Treatment Plant) বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- অবৈধ দখল উচ্ছেদ:নদীতীর থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নদী অঞ্চল সীমানা নির্ধারণ জরুরি।
- নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প:বিআইডব্লিউটিএ ও এলজিইডি’র মাধ্যমে ড্রেজিং, নদী গভীরীকরণ এবং ঘাট পুনরুদ্ধারের প্রকল্প নিতে হবে।
- ঐতিহাসিক ঘাট সংরক্ষণ:নারায়ণগঞ্জ, বন্দরের ঐতিহাসিক জেটিগুলোকে “নদী ঐতিহ্য এলাকা” হিসেবে সংরক্ষণের দাবি উঠেছে পরিবেশবাদী মহলে।
অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ
শীতলক্ষ্যা কেবল একটি নদী নয়—এটি আমাদের ইতিহাস, জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির সাক্ষী। একসময় যে নদী যুক্ত করেছিল ঢাকা থেকে কলকাতাকে, যে নদী দিয়েই প্রবাহিত হতো একটি দেশের অর্থনীতি, আজ সেই নদীই মৃত্যুশয্যায়।
শুধু কাগজে পরিকল্পনা নয়—দরকার বাস্তবায়ন, সচেতনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। শীতলক্ষ্যার কথা যেন কেবল ইতিহাসের বইয়ে না থাকে, বরং নতুন প্রজন্মও যেন দেখতে পারে সেই প্রাচীন স্টিমারঘাট, শুনতে পারে জলপথের ছলছল শব্দ, আর দেখতে পারে মাছের ঝাঁক।
এই নদীই একদিন আবার ফিরে আসুক ঢাকার প্রাণরেখা হয়ে—এই প্রত্যাশাই আজকের।