দেশের কৃষি খাতে ব্যবহৃত কীটনাশকের স্থানীয় উৎপাদনকারীরা বৈষম্যমূলক শুল্ক কাঠামোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAMA)। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে সংগঠনটি কীটনাশক কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট হ্রাস এবং কিছু কর বাতিলের সুপারিশ করেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের কীটনাশক উৎপাদকরা বর্তমানে কাঁচামাল আমদানিতে ৩৭ শতাংশ থেকে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত কর পরিশোধ করছেন, যেখানে প্রস্তুত পণ্য আমদানিকারীরা অনেক কম হারে কর দিচ্ছেন। এ অবস্থায় স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়।
বৈষম্যমূলক কর কাঠামোর চিত্র
চিঠিতে বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, কীটনাশক কাঁচামালের মধ্যে এমন কিছু পণ্যের ওপর বর্তমানে ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত সম্মিলিত শুল্ক ও কর আরোপ করা হচ্ছে। যেমন কিছু রাসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রে ৫% কাস্টমস ডিউটি, ৫% অগ্রিম আয়কর (AIT), ৫% ভ্যাট এবং ১৫% পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক শুল্ক (RD) মিলিয়ে মোট কর দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত। আবার কিছু ক্ষেত্রে, যেমন খনিজভিত্তিক উপাদান বা সার-সম্পর্কিত কাঁচামালের ওপর মোট করহার ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
অন্যদিকে, এই একই ধরনের পণ্যের প্রস্তুত ফর্ম আমদানির সময় শুধুমাত্র ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কর বসানো হয়, যা স্থানীয় উৎপাদকদের তুলনায় অনেক কম। ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে গিয়ে কাঁচামালের কর বাবদ যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তা আমদানিকৃত প্রস্তুত পণ্যের আমদানিকারীদের বহন করতে হয় না। এটি স্থানীয় শিল্পের জন্য এক ধরনের বৈষম্য এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
BAMA-এর প্রস্তাব
সংগঠনটি এনবিআরকে নিম্নলিখিত প্রস্তাব দিয়েছে:
- কীটনাশকের কাঁচামালের ওপর শুল্ক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা
- AIT (অগ্রিম আয়কর) ও RD (নিয়ন্ত্রক শুল্ক) পুরোপুরি বাতিল
- দেশীয় প্রস্তুতকারকদের জন্য আলাদা কর সুবিধা নির্ধারণ
- প্রস্তুত পণ্যের তুলনায় কাঁচামালে করহার কম রাখা
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “দেশীয় শিল্প বাঁচাতে না পারলে আমরা বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব এবং কৃষকের খরচও বেড়ে যাবে।”
কৃষিতে সম্ভাবনার দিগন্ত
BAMA-এর মতে, শুল্ক কাঠামো সংস্কার করা হলে দেশের কৃষি খাতে বহুমুখী সুফল আসতে পারে:
- কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে: সাশ্রয়ী দামে কীটনাশক পাওয়া গেলে কৃষকরা বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারবেন।
- স্থানীয় শিল্প বিকশিত হবে: স্থানীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে নতুন উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে পারবে।
- রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়বে: মানসম্মত উৎপাদন বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে।
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে: উৎপাদন, প্যাকেজিং, পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মত
রাজধানীর একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“দেশীয় কীটনাশক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুল্ক ও করনীতি পুনর্বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি। বিদেশি প্রস্তুত পণ্যের বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদনের সুবিধা না থাকলে কৃষি খাতের ওপর দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়বে।”
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান বলেন,
“জাতীয় স্বার্থে এই ধরনের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিতে দক্ষতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকারকে BAMA-এর এই দাবি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।”
এনবিআরের অবস্থান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,
“আমরা বাজেটপূর্ব প্রস্তাবগুলোর মধ্যে BAMA-এর আবেদন পেয়েছি। শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ও কৃষি খাতের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।”
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে কীটনাশক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই শিল্পকে সুরক্ষা ও উৎসাহিত করতে হলে বৈষম্যমূলক শুল্ক কাঠামো সংস্কার জরুরি। BAMA-এর সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতির পরিপূর্ণ উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।