১১:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

জাপানে চাল-সংকট, বাংলাদেশেও দামে আগুন

জাপানের চাল-সংকট: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

১৯১৮ সালের জুলাইয়ে জাপানের তোয়ামা প্রদেশে মাছ ধরার নারীদের ক্ষোভ থেকে যে চাল-বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। চালের দামের ঊর্ধ্বগতি সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শত বছর পর, ২০২৫ সালে জাপান আবারও একই ধরনের চাল-সংকটে পড়েছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যার জেরে পদত্যাগ করেছেন কৃষিমন্ত্রী এতো তাকু।

জাপানে চাল কেবল খাদ্য নয়, এটি জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে দেশে ৯৯ শতাংশ চাল স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হয় এবং বিদেশি আমদানির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে উৎপাদনে সামান্য ধাক্কাও বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ২০২৩ সালের খারাপ ফলনের পর থেকে জাপানের চালবাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা এখনো কাটেনি।

চালের দাম ও সরকার: বিপাকে জাপানশিক্ষা বাংলাদেশের জন্য

জাপান সরকার চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের মজুদ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল ছাড় করেছে। প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার টনের সরকারি মজুদের মধ্যে এখন মাত্র এক লাখ টনের মতো অবশিষ্ট রয়েছে। দোকানে এখন এক, দুই, তিন বছর আগের চাল বিক্রি হচ্ছে, যার ফলে ভাষায় নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে—“কোকোমাই” (পুরনো চাল), “কোকোকোমাই” (আরও পুরনো চাল)।

ব্যবসায়ীরা যেন অতিরিক্ত দামে চাল বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য জাপান সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে—মূল্যবৃদ্ধি করে চাল বিক্রি করলে এক বছরের জেল বা ১০ লাখ ইয়েন (প্রায় ৬,৯০০ ডলার) জরিমানার বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ: চালের দামে টাননীরব আতঙ্ক

বাংলাদেশে চালের বাজারে এখনো জাপানের মতো উন্মাদনা না থাকলেও গত এক বছরে চালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সরু চালের কেজি ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, মোটা চালের দাম ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকায় পৌঁছেছে। শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো খাদ্য ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বাংলাদেশে চালের উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে মোটামুটি সক্ষম হলেও বাজার ব্যবস্থাপনা দুর্বল, মজুদদারি প্রবণতা এবং আমদানিনির্ভরতা (বিশেষত কিছু নির্দিষ্ট ধরণের চালে) বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।

সরকারের ভূমিকা: নিয়ন্ত্রণ না নজরদারি?

বাংলাদেশ সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খোলাবাজারে ওএমএস চালু করেছে। তবে সরবরাহ অপ্রতুল এবং অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ খুব একটা উপকৃত হচ্ছেন না। সরকারি মজুদ অনেক সময় খাতায়-কলমে থাকলেও বাস্তবে তা বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের হুমকি থাকলেও বাস্তবে শাস্তির নজির খুবই কম।

জাপান থেকে শিক্ষা: চালের দাম শুধু অর্থনৈতিক ইস্যু নয়

জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়—চালের দাম কেবল খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক ইস্যুতেও রূপ নিতে পারে। জাপানের মতো জনবহুল বাংলাদেশে চালের মূল্যবৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে সামনে ঈদ বা কোনো রাজনৈতিক সংকটের সময়ে।

বাংলাদেশে যদি উৎপাদনে ধাক্কা লাগে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সংকট আরও তীব্র হতে পারে। জাপানের মতো বড় মজুদ গড়ে তোলা, পুরনো চাল ব্যবস্থাপনা এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

চাল শুধু খাদ্য নয়রাজনৈতিক বারোমাসী সংকটও

বাংলাদেশের চালনীতি কেবল কৃষকের সমস্যা নয়, এটি ভোক্তা, বাজার, সরকার ও রাজনীতির পারস্পরিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন। জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত—চালের দাম যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে তা সরকার, বাজার ও সাধারণ মানুষের পারস্পরিক আস্থায়ও আঘাত হানতে পারে।

এখন সময় চালবাজারে স্বচ্ছতা, তথ্যনির্ভর নীতিনির্ধারণ এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার। না হলে একদিন ‘কোকোকোমাই’ নয়, আমাদের বাজারে ‘বেহাল চাল’ হয়ে উঠতে পারে জাতির মেরুদণ্ড।

জাপানে চাল-সংকট, বাংলাদেশেও দামে আগুন

০৫:০০:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

জাপানের চাল-সংকট: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

১৯১৮ সালের জুলাইয়ে জাপানের তোয়ামা প্রদেশে মাছ ধরার নারীদের ক্ষোভ থেকে যে চাল-বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। চালের দামের ঊর্ধ্বগতি সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শত বছর পর, ২০২৫ সালে জাপান আবারও একই ধরনের চাল-সংকটে পড়েছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যার জেরে পদত্যাগ করেছেন কৃষিমন্ত্রী এতো তাকু।

জাপানে চাল কেবল খাদ্য নয়, এটি জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে দেশে ৯৯ শতাংশ চাল স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হয় এবং বিদেশি আমদানির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে উৎপাদনে সামান্য ধাক্কাও বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ২০২৩ সালের খারাপ ফলনের পর থেকে জাপানের চালবাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা এখনো কাটেনি।

চালের দাম ও সরকার: বিপাকে জাপানশিক্ষা বাংলাদেশের জন্য

জাপান সরকার চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের মজুদ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল ছাড় করেছে। প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার টনের সরকারি মজুদের মধ্যে এখন মাত্র এক লাখ টনের মতো অবশিষ্ট রয়েছে। দোকানে এখন এক, দুই, তিন বছর আগের চাল বিক্রি হচ্ছে, যার ফলে ভাষায় নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে—“কোকোমাই” (পুরনো চাল), “কোকোকোমাই” (আরও পুরনো চাল)।

ব্যবসায়ীরা যেন অতিরিক্ত দামে চাল বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য জাপান সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে—মূল্যবৃদ্ধি করে চাল বিক্রি করলে এক বছরের জেল বা ১০ লাখ ইয়েন (প্রায় ৬,৯০০ ডলার) জরিমানার বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ: চালের দামে টাননীরব আতঙ্ক

বাংলাদেশে চালের বাজারে এখনো জাপানের মতো উন্মাদনা না থাকলেও গত এক বছরে চালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সরু চালের কেজি ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, মোটা চালের দাম ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকায় পৌঁছেছে। শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো খাদ্য ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বাংলাদেশে চালের উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে মোটামুটি সক্ষম হলেও বাজার ব্যবস্থাপনা দুর্বল, মজুদদারি প্রবণতা এবং আমদানিনির্ভরতা (বিশেষত কিছু নির্দিষ্ট ধরণের চালে) বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।

সরকারের ভূমিকা: নিয়ন্ত্রণ না নজরদারি?

বাংলাদেশ সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খোলাবাজারে ওএমএস চালু করেছে। তবে সরবরাহ অপ্রতুল এবং অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ খুব একটা উপকৃত হচ্ছেন না। সরকারি মজুদ অনেক সময় খাতায়-কলমে থাকলেও বাস্তবে তা বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের হুমকি থাকলেও বাস্তবে শাস্তির নজির খুবই কম।

জাপান থেকে শিক্ষা: চালের দাম শুধু অর্থনৈতিক ইস্যু নয়

জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়—চালের দাম কেবল খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক ইস্যুতেও রূপ নিতে পারে। জাপানের মতো জনবহুল বাংলাদেশে চালের মূল্যবৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে সামনে ঈদ বা কোনো রাজনৈতিক সংকটের সময়ে।

বাংলাদেশে যদি উৎপাদনে ধাক্কা লাগে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সংকট আরও তীব্র হতে পারে। জাপানের মতো বড় মজুদ গড়ে তোলা, পুরনো চাল ব্যবস্থাপনা এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

চাল শুধু খাদ্য নয়রাজনৈতিক বারোমাসী সংকটও

বাংলাদেশের চালনীতি কেবল কৃষকের সমস্যা নয়, এটি ভোক্তা, বাজার, সরকার ও রাজনীতির পারস্পরিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন। জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত—চালের দাম যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে তা সরকার, বাজার ও সাধারণ মানুষের পারস্পরিক আস্থায়ও আঘাত হানতে পারে।

এখন সময় চালবাজারে স্বচ্ছতা, তথ্যনির্ভর নীতিনির্ধারণ এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার। না হলে একদিন ‘কোকোকোমাই’ নয়, আমাদের বাজারে ‘বেহাল চাল’ হয়ে উঠতে পারে জাতির মেরুদণ্ড।