১১:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধির ওপর। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি ব্যাপকভাবে আমদানি-নির্ভর হওয়ায় হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবল চাপের মুখে পড়তে পারে।

হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব কী?

হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ। সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপুল তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এই পথ দিয়ে বিশ্ববাজারে পৌঁছে।

বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব

জ্বালানি খাতে বড় ধাক্কা

বাংলাদেশ কুয়েত, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে বিপুল পরিমাণ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে থাকে। এই সরবরাহ হঠাৎ ব্যাহত হলে দেশে জ্বালানির তীব্র ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে, যা শিল্প খাত থেকে শুরু করে কৃষি ও গৃহস্থালি ব্যবহার — সবখানেই প্রভাব ফেলবে।

জ্বালানি দামের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি

জ্বালানি আমদানিতে বিলম্ব ও সরবরাহ সংকটের কারণে তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেলে বাংলাদেশকে একই পরিমাণ জ্বালানির জন্য বাড়তি মূল্যে আমদানি করতে হবে। এর ফলে সরকারি ভর্তুকি বৃদ্ধি পাবে, অথবা তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে অভ্যন্তরীণ বাজারে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে পরিবহন, কৃষি এবং ভোক্তা পর্যায়ে; মুদ্রাস্ফীতির হার হঠাৎ বাড়তে পারে।

রেমিট্যান্স প্রবাহে সম্ভাব্য বিঘ্ন

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত, যাঁরা মূলত উপসাগরীয় দেশগুলোতেই অবস্থান করছেন। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে ওই অঞ্চলের অর্থনীতি হোঁচট খেতে পারে, বিশেষ করে যদি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। তখন শ্রমিকদের চাকরি হারানো বা বেতন কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এতে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে।

বাণিজ্যপথে বিলম্ব ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি

বাংলাদেশে আমদানি হওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্যশস্য, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আসে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে এই রুট ব্যাহত হবে এবং বিকল্প দীর্ঘ রুট ব্যবহারে সময় ও খরচ বাড়বে। এতে শিল্প উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়বে।

বিকল্প প্রস্তুতি কি আছে?

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে কী করা হবে — এ বিষয়ে এখনো বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুতই দীর্ঘমেয়াদী আমদানি পরিকল্পনা, বিকল্প উৎস নির্ধারণ এবং কৌশলগত তেল মজুত বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ওপর আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে।

বিশ্লেষকদের মত

একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিবের মতে, “হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়া মানেই জ্বালানি খাতে বৈশ্বিক সঙ্কট। বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর অর্থনীতি এতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে। এখন থেকেই সরকারের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।”

এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সরকার বিকল্প রুট ও জ্বালানি উৎস নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।”

ইরান যদি সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানি ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যে ধাক্কা এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে বিঘ্ন — সব মিলিয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাই এখনই পরিকল্পিত ও বহুমুখী প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে

০৪:১৮:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধির ওপর। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি ব্যাপকভাবে আমদানি-নির্ভর হওয়ায় হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবল চাপের মুখে পড়তে পারে।

হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব কী?

হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ। সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপুল তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এই পথ দিয়ে বিশ্ববাজারে পৌঁছে।

বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব

জ্বালানি খাতে বড় ধাক্কা

বাংলাদেশ কুয়েত, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে বিপুল পরিমাণ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে থাকে। এই সরবরাহ হঠাৎ ব্যাহত হলে দেশে জ্বালানির তীব্র ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে, যা শিল্প খাত থেকে শুরু করে কৃষি ও গৃহস্থালি ব্যবহার — সবখানেই প্রভাব ফেলবে।

জ্বালানি দামের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি

জ্বালানি আমদানিতে বিলম্ব ও সরবরাহ সংকটের কারণে তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেলে বাংলাদেশকে একই পরিমাণ জ্বালানির জন্য বাড়তি মূল্যে আমদানি করতে হবে। এর ফলে সরকারি ভর্তুকি বৃদ্ধি পাবে, অথবা তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে অভ্যন্তরীণ বাজারে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে পরিবহন, কৃষি এবং ভোক্তা পর্যায়ে; মুদ্রাস্ফীতির হার হঠাৎ বাড়তে পারে।

রেমিট্যান্স প্রবাহে সম্ভাব্য বিঘ্ন

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত, যাঁরা মূলত উপসাগরীয় দেশগুলোতেই অবস্থান করছেন। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে ওই অঞ্চলের অর্থনীতি হোঁচট খেতে পারে, বিশেষ করে যদি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। তখন শ্রমিকদের চাকরি হারানো বা বেতন কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এতে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে।

বাণিজ্যপথে বিলম্ব ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি

বাংলাদেশে আমদানি হওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্যশস্য, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আসে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে এই রুট ব্যাহত হবে এবং বিকল্প দীর্ঘ রুট ব্যবহারে সময় ও খরচ বাড়বে। এতে শিল্প উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়বে।

বিকল্প প্রস্তুতি কি আছে?

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে কী করা হবে — এ বিষয়ে এখনো বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুতই দীর্ঘমেয়াদী আমদানি পরিকল্পনা, বিকল্প উৎস নির্ধারণ এবং কৌশলগত তেল মজুত বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ওপর আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে।

বিশ্লেষকদের মত

একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিবের মতে, “হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়া মানেই জ্বালানি খাতে বৈশ্বিক সঙ্কট। বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর অর্থনীতি এতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে। এখন থেকেই সরকারের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।”

এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সরকার বিকল্প রুট ও জ্বালানি উৎস নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।”

ইরান যদি সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানি ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যে ধাক্কা এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে বিঘ্ন — সব মিলিয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাই এখনই পরিকল্পিত ও বহুমুখী প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।