হরমুজ প্রণালীর ওপর এশিয়ার নির্ভরতা
মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাসের ওপর এশিয়ার ব্যাপক নির্ভরতা রয়েছে। ফলে ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে এশীয় দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথ দিয়েই বিশ্বে ব্যবহৃত প্রায় ২০ শতাংশ তেল ও গ্যাস পরিবহন হয়।
সম্প্রতি ইরানের সংসদ একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যেখানে বলা হয়েছে — যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের হাতে রয়েছে।
এই আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ শতাংশ বেড়ে ৮১ ডলারে পৌঁছায়, যদিও পরে তা কমে ৮০ ডলারের নিচে চলে আসে।
শেল কর্পোরেশনের সিইও ওয়েল সাওয়ান বলেন, “এই প্রণালী বিশ্ব জ্বালানির প্রধান শিরা। যদি তা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্ষতি
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদিন প্রায় ১৫ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল হরমুজ দিয়ে পরিবাহিত হয়, যার ৮০ শতাংশ এশিয়ায় আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যায় চীন ও ভারতে।
রিস্ট্যাড এনার্জির মতে, আগে এই ঘাটতি রাশিয়া, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, অ্যাঙ্গোলা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পূরণ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে এসব উৎস থেকে তেল সংগ্রহ করা জটিল হয়ে পড়েছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে। এই দুই দেশই প্রণালী দিয়ে পাঠানো মোট তেলের ২৪ শতাংশের গন্তব্য। এছাড়া সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তেল ও জ্বালানি আমদানি করে থাকে।
গ্যাস সরবরাহেও বিশাল নির্ভরতা
প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন ব্যারেল পেট্রোলিয়াম পণ্য—যেমন গ্যাসোলিন ও ডিজেল—এই প্রণালী দিয়ে যায়, যার ৬০ শতাংশই যায় এশিয়ায়। একইভাবে, এই পথ দিয়ে পরিবাহিত তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (LNG) ৮০ শতাংশেরও বেশি যায় এশিয়া, বিশেষ করে চীন ও ভারতে।
কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যারা বিশ্বের অন্যতম বড় LNG রপ্তানিকারক, হরমুজ প্রণালীর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশও এখান থেকে গ্যাস আমদানি করে।
সম্পূর্ণ বন্ধের ঝুঁকি এখনো কম
ইরান আগেও বহুবার হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়েছে, এমনকি ১৯৮০ এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ও। তবে কখনোই পুরোপুরি এই জলপথ বন্ধ করেনি।
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরো প্রণালী বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি এখনো কম, মাত্র ২০ শতাংশ। তাদের মতে, ইরান এখনই শক্তভাবে জ্বালানি স্থাপনায় আঘাত হানবে না, কারণ তাদের নিজস্ব রপ্তানি সুবিধাও তখন হুমকির মুখে পড়বে।
তবে তারা সতর্ক করেছেন যে, ইরান ট্যাংকার চলাচলে বাড়তি হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
চীনের প্রতিক্রিয়া: একটি বড় হিসাব
বিশ্লেষক তাকাহিদে কিউচি মনে করেন, ইরানের হরমুজ বন্ধের পরিকল্পনা চীনকে ক্ষুব্ধ করতে পারে। কারণ চীন ইরানের সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা এবং জাতিসংঘে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ইরানকে সহায়তা করে থাকে। তাই ইরানের জন্য চীনকে বিরক্ত করা একটি বড় ঝুঁকি।
তার ভাষায়, “চীন এই পথে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই হুমকি থাকা সত্ত্বেও হরমুজ বন্ধ করা ইরানের জন্য কঠিন একটি সিদ্ধান্ত।”
মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা: আবার ১০০ ডলারের উপরে তেল?
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি হরমুজ প্রণালীতে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে, তবে তেলের দাম ১০০ ডলারেরও বেশি হয়ে যেতে পারে। ইউরোপ ও এশিয়া যখন সীমিত এলএনজি নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবে, তখন গ্যাসের দামও দ্রুত বাড়বে।
গোল্ডম্যান স্যাচসের মতে, যদি এক মাসে হরমুজ দিয়ে তেল পরিবহন ৫০ শতাংশ কমে যায় এবং এরপর ১১ মাস ধরে তা ১০ শতাংশ কম থাকে, তাহলে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম সাময়িকভাবে ১১০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। ইউরোপীয় গ্যাসের দাম ২০২২ সালের জ্বালানি সংকটের সময়কার স্তরে উঠে যেতে পারে, তখন উচ্চমূল্যের কারণে চাহিদা অনেকটাই কমে গিয়েছিল।
মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনীতি: সবচেয়ে ঝুঁকিতে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান
মুডিজ অ্যানালাইটিক্সের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ স্টেফান অ্যাংরিক বলেন, জ্বালানি ও পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে এশিয়ার মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি আরও বাড়বে। তার মতে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো উচ্চ আয়ের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ তারা খাদ্য ও জ্বালানির আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, “এতে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে, মুদ্রার মান কমবে এবং মুদ্রাস্ফীতিও বাড়বে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানোর পরিকল্পনা স্থগিত করতে পারে বা আবার বাড়াতে পারে।”
হরমুজ প্রণালী মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস প্রবাহের মূল পথ। ইরান যদি রাজনৈতিক উত্তেজনায় এই প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তাহলে এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও পূর্ণাঙ্গ বন্ধের আশঙ্কা কম, তবুও যে কোনো ধরনের বিঘ্নতা জ্বালানি বাজারে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যার প্রভাব পড়বে মুদ্রাস্ফীতি, বাণিজ্য ভারসাম্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণে।