বৈজ্ঞানিক গবেষণায় চীনের অগ্রগতি
মাত্র এক দশক আগেও বিশ্বের শীর্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় আমেরিকা ও ইউরোপের আধিপত্য ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে চিত্রটি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। নেচার ইনডেক্সের সর্বশেষ র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ দশটি গবেষণা-ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটিই এখন চীনের।
নেচার নামক প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ২০১৬ সালে বিভিন্ন স্বীকৃত বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে একটি সূচক তৈরি করে, যা প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক অবদানের ভিত্তিতে র্যাঙ্ক করে। ২০১৬ সালে যেখানে শীর্ষ দশে আমেরিকা ও ইউরোপের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, ২০২৪ সাল নাগাদ সেখানে মাত্র তিনটি পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানই টিকে ছিল: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ফরাসি গবেষণা প্রতিষ্ঠান CNRS এবং জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটি। ২০২৫ সালে এই তিনটির মধ্যে হার্ভার্ড দ্বিতীয় এবং ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক নবম স্থানে আছে, বাকি আটটি স্থান দখল করেছে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিনিয়োগে ধারাবাহিকতা, ফলাফলও দৃশ্যমান
চীন গত এক দশকে গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বার্ষিক গড়ে ৯ শতাংশ হারে বাস্তব অর্থে ব্যয় বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে ক্রয় ক্ষমতা সমন্বয়ে চীন সরকারি ও উচ্চশিক্ষা গবেষণায় আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে।
চীন বিদেশে অবস্থানরত অনেক গবেষককেও ফিরিয়ে এনেছে, যাদের ‘হাইগুই’ (সমুদ্র পেরিয়ে ফেরা) নামে ডাকা হয়। এই সব নীতির ফলে চীন এখন বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক উচ্চ-প্রভাবসম্পন্ন (শীর্ষ ১% বেশি উদ্ধৃত) গবেষণাপত্র প্রকাশ করছে। বিশেষত রসায়ন, প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো ক্ষেত্রে চীন বিশ্ব নেতৃত্বে চলে এসেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের ইনডেক্সে চতুর্থ স্থানে থাকা চীনের চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লিয়াং ওয়েনফেং, ডিপসিক (DeepSeek) নামের একটি শীর্ষস্থানীয় এআই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।
সূচকের কাঠামোই চীনের জন্য সহায়ক?
তবে গবেষণাপত্র নির্বাচনের পদ্ধতি কিছুটা চীনের পক্ষে কাজ করেছে। নেচার ইনডেক্সে নির্বাচিত জার্নালগুলো মূলত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ভিত্তিক, যার মধ্যে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের আধিপত্য। এই দুটি শাখা চীনের তুলনামূলক শক্তি, এবং তাই তাদের প্রতিষ্ঠানের রেটিং বেড়েছে। বিপরীতে, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল — যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো এখনো এগিয়ে — তার মাত্র ২০ শতাংশই ইনডেক্সে অন্তর্ভুক্ত।
যখন শুধুমাত্র নেচার ও সায়েন্স — বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দুটি জার্নাল — বিবেচনায় নেওয়া হয়, তখন চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো এই তালিকায় অনেক নিচে নেমে যায়। শুধু চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেস (CAS) এই সূচকে চতুর্থ স্থানে আছে।
র্যাঙ্কিং মানেই শ্রেষ্ঠত্ব নয়
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের র্যাঙ্কিং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর সীমাবদ্ধতাও আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা নিচু পর্যায়ের জার্নালেও প্রকাশ পায়, এবং বিশ্ব পরিবর্তনকারী উদ্ভাবন সবসময়ই উচ্চ র্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান থেকে আসে না। তবু স্বীকার করতেই হবে, চীনের চিংহুয়া, পেকিং এবং চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং CAS বিশ্বসেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাতারে পৌঁছে গেছে।
গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ, বিদেশফেরত মেধার সঠিক ব্যবহার এবং শক্তিশালী কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে চীন বৈজ্ঞানিক বিশ্বে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। তবে ভবিষ্যতে এই অগ্রযাত্রা টিকিয়ে রাখতে হলে, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে — যেখানে এখনো পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্য বিদ্যমান।