ছোটবেলায় জ্যাঠামশায়ের লাইব্রেরিতে টাঙানো রামমোহনের তৈলচিত্রটিকে জানতাম রাজার ছবি হিসেবে। বিবেকানন্দের ছবিকে চিনতাম ‘বীর সন্ন্যাসী’ নামে। রাজাকে তখন রাজা রায় প্রতাপাদিত্য, রাজা বসন্ত রায়ের সঙ্গেই মেলাতাম। তবে সন্ন্যাসী হিসেবে বিবেকানন্দই বেশি টানত। মাতৃকূলে ছোট দাদু-সহ মামা, মাসি মিলে ছয়জনেরও বেশি সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী ছিলেন। তাঁদের গল্প শুনে শুনে ছোটবেলা থেকেই সন্ন্যাসটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম বলে মনে হয়েছিল। তখনও ‘এ সংসার অনিত্য’—এসব বোঝার বয়স হয়নি। বাবা সুভাষ বসুর অনুসারী হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই সুভাষ বোস ছিলেন রূপকথার নায়ক, আর কবিগুরু তো সেই ছোট্ট বেলা থেকেই এক আপনজন—কখনও ‘বাবা যদি রামের মতো পাঠায় আমায় বনে’, কখনও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ‘আমি তোমার খোকা’, আবার কখনও বীর বেশের খোকা।
তাই যেন ধরে নিয়েছিলাম রাজার ছবি আর বিবেকানন্দের ছবি প্রণাম করার কথা—একান্তই নিজের ইচ্ছায় (কেউ কখনও বলে দেয়নি)। এ দুটি ছবির বাইরে, হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী সন্তান হিসেবে প্রণাম করতাম মন্দিরের প্রতিমাকে।
মন্দিরের ওই প্রতিমাগুলোকে প্রণাম করতাম বছরে মাত্র কয়েকবার—বিশেষ করে দীপাবলি ও কালীপূজায় এবং বাসন্তী পূজা (বসন্তকালীন দুর্গাপূজা)-র সময়ে। স্কুল-কলেজে পড়ার দিনগুলোয় এ ছিল বাৎসরিক বিষয়। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর এক পরিবারে এ সময়েই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো। ছোটবেলা থেকে একটু ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায়, ঠাকুরদা হাত ধরে মন্দিরের ভেতর না নিয়ে গেলে নিজের আত্মীয়দের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে প্রণাম করতে পারতাম না।
তবে ওই প্রতিমা ঘিরে বহু স্মৃতি এখনও জেগে ওঠে। যেমন এই প্রৌঢ়ত্বেও ভোরের ঘুম ভাঙা চোখে মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। মায়ের মুখের মতো প্রতি মুহূর্তে মনে না থাকলেও, প্রৌঢ়ত্বের স্মৃতিতে মন্দিরের প্রতিমার মুখ যেমন ভাসে, তেমনি আরেকটি মুখ বা তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্মৃতিও জেগে ওঠে।
আগেই বলেছি, ছোটবেলায় বড় বেশি ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম। তাছাড়া দক্ষিণ বাংলায়—অর্থাৎ রায় প্রতাপাদিত্যর বাংলায়—তখনও নদী ছেড়ে ডাঙ্গায় চলে আসত কুমির, আর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে থাকত হাঙর; আমবাগান-সুপারি বাগানে সাপের রাজত্ব। তাই মায়ের ছোট সন্তানকে পাঁচিলের ভেতরেই থাকতে হতো। এ কারণে গ্রামে তেমন কোনো বন্ধু ছিল না।
তার পরেও পূজায় বাড়ি গেলে নদী বড় বেশি টানত। মাকে ফাঁকি দিয়ে কুমিরের ভয় কাটিয়ে—জোয়ারভরা নদীর জলের পাশে গিয়ে একা বসে থাকতে ভালো লাগত। বাবার নাচের পা ছিল; আমি ঠিক তাঁর উল্টো হলেও—ভরা জোয়ারের জল যখন নদীর কূলে বাতাস আর স্রোতের দোলায় জলতরঙ্গ তোলে, তখন সেই নীরব নদীর তীরে একা এক কিশোরের শরীরও যেন ওই জলতরঙ্গে নাচত।
দীপাবলিতে অনেকেই নদীতে প্রদীপ ভাসাতেন। আমরা ভাসাতাম প্রপিতামহের দীঘিতে। হাঙর-কুমিরভরা ওই নদীতে প্রতিমা বিসর্জনে আমাদের কোনো অধিকার ছিল না। আমাদের সব আনন্দ তখন বাড়ির সাতরঙা জবা, রক্তকরবী আর হলুদ করবী-ঘেরা বড় পুকুরের জলে। সাঁতার না জানার ফলে আমার আনন্দ সীমাবদ্ধ থাকত পুকুরঘাটের সিঁড়ির জলে বসেই—তার নিচে নয়।
কৈশোরে আমার সঙ্গে আরেক প্রতিমার দেখা হতো। বিসর্জনের পরের দিন জোয়ারের জলে ভেসে আসত নানা মণ্ডপের প্রতিমা। কোনোটি মুখ-সহ ভাসত, কিন্তু হাত নেই; কোনোটি আবার হাতহীন মুখ-মাত্র। সাগরবাহি নদী—কূলে ধানিবন, কেয়া কাঁটা আর এক ধরনের ড্যাফোডিল (গ্রামে ‘কাঁটাঝাড় ফুল’ নামে পরিচিত)-এর সমারোহ। নদীর স্রোতের খেলা, বাতাসের উদাসী বয়ে চলা আর কূলভরা ওই ফুলের সমারোহ পেরিয়ে চোখে পড়ত প্রতিমার সেই দেহাবশেষ। কেন এত গভীরভাবে তাকিয়ে দেখতাম, তা নিয়ে কখনও ভাবিনি, আজও ভাবি না। তবে কোথায় যেন এক দুঃখ জেগে উঠত। মনে হতো—কত ভক্তিনত মাথার ওপরে, কত শ্রদ্ধায় এই প্রতিমা ছিল মন্দিরে! তবু, মুহূর্ত পরে আবার নদী, প্রকৃতি, জোয়ারের দূরন্ত জল, শত শত পালতোলা নৌকা, কখনও মাঝিদের ভাটিয়ালি গান—মনকে টেনে নিয়ে যেত ওই দেহাবশেষ থেকে।
একবার একটি প্রতিমার দেহাবশেষ কুড়িয়ে নিয়েছিল আমার এক ভাগ্নে—যাকে আমি মামা ডাকতাম। বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল; এখন আর নেই। একটু ডানপিটে, দুহাতে বন্দুক চালাতে জানত। তার শিকার দেখে বাবা বলতেন, ‘ও আমার হাত পেয়েছে।’ তার নেতৃত্বে ’৭১-এ শরণার্থী শিবির থেকে ফেরার পথে আমরা কয়েকজন নদীর চরে নেমেছিলাম।
ভারত থেকে আমাদের নৌকা ছেড়েছিল গভীর রাতে। রাস্তায় রাস্তায় তখনও মাইন পোঁতা। তাই নৌপথই নিরাপদ; মানুষবাহী নৌকাকে তখন ‘গহনা নৌকা’ বলা হতো। সেই নৌকায় আমরা শরণার্থী শিবির ছেড়ে এসে ভারতের হাসনাবাদ ঘাট থেকে উঠি। নৌকায় ঘুমোবার আগে মাঝিকে বলেছিলাম, ভোরে সূর্য ওঠার আগেই আমাদের ডেকে দেবেন—স্বাধীন দেশে সূর্যোদয় দেখব। মাঝি ঠিকই সূর্য ওঠার আগেই আমাদের নদীর চরে নামিয়ে দেন। যে মাটিতে জন্মেছি, যে মাটিতে বেড়ে উঠেছি, সেই মাটিতে সেদিন প্রথম পা রাখার অনুভূতি আজকের বাংলাদেশের তরুণকে বোঝানো যাবে না। ওই অনুভূতি লেখার ক্ষমতা আমার নেই—সৈয়দ মুজতবা আলীর কথাই বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে যে মহাকাব্য রচিত হয়েছে, আরেকজন মাইকেল না জন্মানো পর্যন্ত তাকে কেউ প্রকাশ করতে পারবে না।
স্বাধীন দেশের সেই প্রথম সূর্যোদয় দেখার অনুভূতি ব্যর্থভাবে প্রকাশ করে অনুভূতিকেও খাটো করতে চাই না, পাঠককেও ছোট কোনো ধারণা দিতে চাই না। সূর্য তপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা আর নৌকায় ওঠেনি। নৌকা নদী ধরে চলছিল, আর আমরা ক’জন উদ্দাম তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরী নদীর চরের সাপ-কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে আনাড়ি পায়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে এগিয়ে চলেছিলাম। সেই সূর্যালোকে নদীতে যা দেখেছিলাম—সেই বিভৎসতার স্মৃতিচিত্র আজ, ৫৫ বছর পরেও, অকৃতজ্ঞ বাতাসে ভাসাতে চাই না। তা সত্ত্বেও আমরা আনাড়ি পায়ে বেশ জোরে চলেছিলাম চর ধরে।
হঠাৎ আমার ভাগ্নে থমকে দাঁড়াতেই আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাই। দেখি, মাত্র এক পা সামনে চরে পড়ে আছে মানুষের দুটি খুলি আর একটি পাথরের তৈরি দুর্গা প্রতিমার মুখ। ভাগ্নে একটি খুলি ও প্রতিমার মুখটি হাতে নিয়ে আরেকটি খুলিটি আমার হাতে দিল। গ্রামের বাড়িতে রেখেছিলাম সেই খুলিটি—চেয়েছিলাম কাঁচের ফ্রেমে রাখব। সময় দ্রুতই সেই ইচ্ছা নিভিয়ে দেয়। আর পাথরের দুর্গার মুখটি ভাগ্নে নিজের কাছেই রেখেছিল, এতটুকু জানতাম। পরে গৃহে থেকেই সে সন্ন্যাসীর মতো হয়ে যায়; চিরকুমার, সারাক্ষণ সাদা কাপড় পরত। মারা গেছে সাদা কাপড়েই। কোভিডের ভেতর শুধু তার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম; তখন সবাই গৃহবন্দি। কোনো দিন খোঁজ নেয়নি—সেই নদীর চর থেকে তুলে আনা পাথরের দুর্গা প্রতিমার মুখটি সে কী করেছিলো?
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক; সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World