স্বপ্নীল প্রযুক্তি নয়, নতুন নিয়মেই রক্ষা হবে শৈশব
আমেরিকায় বহু বছর ধরে বাবা-মা চেষ্টা করেছেন বাচ্চাদের টিভি দেখা সীমিত রাখতে। কিন্তু স্মার্টফোন আসার পর সেই লড়াই আরও কঠিন হয়েছে। স্মার্টফোন সবখানে যায়, আর টিনএজাররা প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। অনেকে মনে করেন, এই যুদ্ধে তারা হেরে গেছেন।
যখন কেউ বাচ্চাকে হাই স্কুলের আগে স্মার্টফোন দিতে না চায় বা ১৬ বছর হওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ রাখতে চায়, তখন তাদের সন্তানেরা অভিযোগ করে—“আমি তো একমাত্র বঞ্চিত!”
আমরা এই প্রযুক্তি-সংক্রান্ত পারিবারিক টানাপোড়েন বোঝার জন্য দুটি জরিপ চালিয়েছি। এর প্রথম অংশে দেখা যায়, অনেক জেনারেশন জেড তরুণ নিজেদের টিকটক, স্ন্যাপচ্যাটের মতো অ্যাপে আটকে পড়া মনে করে। প্রায় অর্ধেকের বেশি জানায়, তারা এগুলো ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে আফসোস করে।
দ্বিতীয় অংশে আমরা ১০১৩ জন বাবা-মার ওপর জরিপ চালাই। চিত্র আরও হতাশাজনক। অনেকেই স্বীকার করেছেন, সন্তানের হাতে খুব অল্প বয়সেই ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়া তুলে দিয়ে তারা এখন আফসোস করেন।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আর অনুশোচনা
আমাদের জরিপে ৫৫ শতাংশ বাবা-মা বলেছেন, তাদের সন্তান ১২ বছর বয়সের মধ্যেই স্মার্টফোনের প্রাথমিক ব্যবহারকারী হয়ে যায়। ট্যাবলেটের ক্ষেত্রে এই হার ৬১ শতাংশ।
গত ১৫ বছরে বাচ্চারা যত কম বয়সে ডিভাইস পেতে শুরু করেছে, ততই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশের বয়স কমেছে। যদিও ১৩ বছরের নিচে ডেটা সংগ্রহ করা আইনত নিষিদ্ধ, তবুও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের অর্ধেকই ১৩ বছর হওয়ার আগেই অ্যাকাউন্ট খোলে। স্ন্যাপচ্যাটও একই রকম। টিকটকের ক্ষেত্রে এই হার ৫৭ শতাংশ।
প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাবা-মা মনে করেন, তারা সন্তানের হাতে খুব তাড়াতাড়ি সোশ্যাল মিডিয়া তুলে দিয়েছেন। ২২ শতাংশ একই কথা বলেন স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে। কিন্তু মাত্র ১ শতাংশ বাবা-মা মনে করেন তারা দেরি করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, আফসোস প্রযুক্তি দেওয়ার জন্য, আটকানোর জন্য নয়।
টেক-আশাবাদিতা থেকে সামাজিক চাপ
২০১০–১৫ সালের মধ্যে স্মার্টফোনের বিস্তারের সময় প্রযুক্তি নিয়ে এক ধরনের উচ্ছ্বাস ছিল। তখন মনে করা হতো, ‘ডিজিটাল নেটিভ’ হয়ে ওঠা বাচ্চাদের জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু ২০১০-এর দশকের শেষ দিকে দেখা গেল, স্মার্টফোনে বড় হওয়া বাচ্চারা আসলে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিষণ্ণ, একাকী, অমনোযোগী ও স্থূল হয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি বড় কারণ— সামাজিক চাপ। স্মার্টফোন দেওয়া বাবা-মার ৩৯ শতাংশ বলেছেন, তারা দিতে চাননি, কিন্তু বাকি সবার বাচ্চার কাছে থাকায় বাধ্য হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার বেলায় এই চাপ আরও বেশি—৫৪ শতাংশ বাবা-মা বলেছেন, অন্য সবার সন্তান ব্যবহার করছে দেখে তাদেরও দিতে হয়েছে।
কোন প্রযুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আফসোস
আমরা বাবা-মায়েদের জিজ্ঞেস করেছি—“আপনার সন্তানের শৈশবের অভিজ্ঞতা ভাবলে, কোন জিনিসটা কখনো আবিষ্কৃত না হলেই ভালো হতো?”
ফলাফলে দেখা যায়, সাইকেল নিয়ে বাবা-মায়ের আফসোস নেই, যদিও বাচ্চারা এতে পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়। কিন্তু অ্যালকোহল, গান, পর্নোগ্রাফি নিয়ে তাদের স্পষ্ট নেতিবাচক মত।
তাহলে স্মার্টফোন বা ইউটিউবের অবস্থান কোথায়? প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাবা-মা এগুলোর অস্তিত্ব নিয়েই আফসোস করেন। তবে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম নিয়ে আফসোসের মাত্রা অনেক বেশি। টিকটক ও এক্স (সাবেক টুইটার)-এর ক্ষেত্রে আফসোসের হার ৬২ শতাংশ—যা অ্যালকোহল বা গান-এর চেয়েও বেশি।
জেনারেশন জেডের আফসোস
আমাদের প্রথম জরিপে দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জেনারেশন জেড বলেছেন—“আমার জীবনে খুব তাড়াতাড়ি স্মার্টফোন এসেছিল।” ৩৪ শতাংশ একই কথা বলেছেন সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে। ৪৫ শতাংশ বলেছেন, তারা যদি বাবা-মা হন, হাই স্কুলের আগে কখনো স্মার্টফোন দেবেন না।
সমাধানের চারটি প্রস্তাবিত নিয়ম
আমরা পরিবারগুলোকে এই ‘সমষ্টিগত ফাঁদ’ থেকে বের করতে চারটি সামাজিক নিয়মের প্রস্তাব দিয়েছি—যেখানে সবাই বাধ্য হয় অন্যদের দেখাদেখি করতে।
১. হাই স্কুল পর্যন্ত স্মার্টফোন বিলম্ব করা। আমাদের জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ বাবা-মা বলেছেন, অন্তত ১৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান।
২. ১৬ বছর হওয়া পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া বিলম্ব করা। ৭৩ শতাংশ বাবা-মা এই মতের পক্ষে, ৭০ শতাংশ চান আইনি ন্যূনতম বয়স ১৬ হোক।
৩. স্কুলগুলো ফোনমুক্ত করা—প্রথম ঘণ্টা থেকে শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত, এমনকি টিফিন ও ছুটির সময়ও। ৬৩ শতাংশ বাবা-মা এই নীতির পক্ষে।
৪. বাচ্চাদের বাস্তব জীবনে স্বাধীনতা, খোলা খেলাধুলা, দায়িত্ব দেওয়া। ৬ থেকে ১২ বছরের বাচ্চার অভিভাবকদের ৪০ শতাংশ বলেন, তারা সন্তানকে বন্ধুদের সাথে বাইরে একা থাকতে দিতে চান। টিনএজ সন্তানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৪৭ শতাংশ।
এই সমর্থন সব জাতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভাজন পেরিয়ে যায়। অনেক বাবা-মা আইনপ্রণেতা, শিক্ষক, স্কুল সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে এই আইডিয়া এগিয়ে নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি রাজ্যে স্কুল পুরোপুরি ফোনমুক্ত করা হয়েছে। আরও ২১ রাজ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, ১৪ রাজ্য ও ডিসিতে নতুন আইন বিবেচনা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, ব্রাজিলের সব স্কুলে ফোনমুক্ত নীতি চালু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সোশ্যাল মিডিয়ার বয়সসীমা ১৬ করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছেন, ইইউ না করলে ফ্রান্স ১৫ বছর ন্যূনতম বয়সসীমা করবে।
আজ যখন এআই “বন্ধু”, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি টিউটর ইত্যাদিতে প্রযুক্তি আরও প্রবলভাবে ঢুকছে, তখন বাবা-মা ও নীতিনির্ধারকদের পদক্ষেপ নেওয়া আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। লক্ষ্য শুধু স্ক্রিন সীমিত করা নয়—লক্ষ্য শৈশব ফিরিয়ে আনা।